সোমবার, ৩০ জুলাই, ২০১২

যাযাবরের...."দৃষ্টিপাত"!!

প্রথমেই বলব, "যাযাবর" এর "দৃষ্টিপাত" সার্থক নামকরণ৷ কেননা, যাযাবর হিসাবে.. দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, রীতি-নীতি, মানুষ, মানুষের জীবনদর্শন একেবারেই নিজের ভঙ্গিতে উঠে এসেছে.."দৃষ্টিপাত" এ৷ অকপটে বলে যাওয়া কাহিনী যেখানে ইতিহাসকেও খুঁড়ে দেখা হয়েছে...আবার বাস্তব জীবনের ঘরগুলোর ভেতরকার ছবিও উঠে এসেছে৷ যদিও "দৃষ্টিপাত" কোন গল্প কিংবা উপন্যাস নয়৷ এ একেবারেই অচেনা লোকদের পত্র পড়া, যদিও লুকিয়ে নয়৷ সংকলিয়তা, ভূমিকা আকারে নিবেদন করেছেন যে.....পুরোটাই উঠিয়ে দিচ্ছি...


"এই রচনাটির একটু ভূমিকা আবশ্যক৷ ১৯৩৬ সালে একটি বাঙ্গালী যুবক লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়িতে যায়৷ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে গাওয়ার স্ট্রিটের ভারতীয় আবাসটি জার্মান বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হইলে আত্মীয়বর্গের নির্বন্ধাতিশয্যে যুবকটি ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসে৷ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপসের আলোচনার প্রাক্কালে বিলাতের একটি প্রাদেশিক পত্রিকা তাহাকে তাহাদের নিজস্ব সংবাদদাতা নিযুক্ত করিয়া দিল্লীতে পাঠান৷ লন্ডনে অবস্থানকালে এই পত্রিকায় সে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখিত৷

দিল্লীতে যাইয়া যুবকটি তাহার এক বান্ধবীকে কতগুলো পত্র লেখে৷ বর্তমান রচনাটি সেই পত্রগুলি হইতে সংকলিত.............

এই স্বল্পপরিসর পত্ররচনার মধ্যে লেখকের যে সাহিত্যিক প্রতিভার আভাস আছে, হয়তো উত্তরকালে বিস্তৃত সাহিত্য চর্চার মধ্যে একদা তাহা যথার্থ পরিণতি লাভ করিতে পারিত৷ গভীর পরিতাপের বিষয়, কিছুকাল পূর্বে এক আকস্মিক দূর্ঘটনায় তার অকালমৃতু্য সেই সম্ভাবনার উপরে নিশ্চিত যবনিকা টানিয়া দিয়াছে৷"
যদি এই রচনাটি কেউ পড়ে থাকেন তবে একমত পোষণ করতে বাধ্য, আর যদি কেউ না পরে থাকেন... তবে অনুরোধ রইল একবার হলে ঘেঁটে দেখার৷


লেখক তার দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন দেখেছেন, বুঝেছেন....অকপটে লিখেছেন...এই যেমন

"সংস্কারের মুক্তি তো যুক্তি দিয়ে হয় না, যেমন বুদ্ধি দিয়ে জয় হয় না ভূতের ভয়৷ সংস্কার রাতারাতি পরিহার করতে হলে চাই বিপ্লব, রয়ে-সয়ে করতে হলে চাই অভ্যাস৷ "
"মানুষের বহু বিচিত্র, তার পরিচয়ের নাই শেষ৷ তার সত্তা ধ্রুব নয়, পরিবেশের পরিবর্তনে তার প্রকাশ হবে বিভিন্ন৷"

ভারতের ইতিহাসে ধর্মের অনুসারীরা তার দৃষ্টিতে কিছুটা এইরকম...

"হিন্দুরা তপস্বী, তারা দিয়েছে বেদ ও উপনিষদ৷ মুসলমানেরা শিল্পী, তারা দিয়েছে তাজ ও রঙমহল৷ হিন্দুরা সাধক, তারা দিয়েছে দর্শন৷ মুসলমানেরা গুণী, তারা দিয়েছে সঙ্গীত৷ হিন্দুরা গর্ব মেধার, মুসলমানেরা গৌরব হৃদয়ের৷"

নিজে জার্নালিস্ট ছিলেন বলেই কিনা...

"জেন্টলম্যানরা যদি জার্নালিস্ট হতে পারেন, জার্নালিস্টরা জেন্টলম্যান হতে পারবেন না কেন?"

"মানুষের জীবন যখন জটিল হয় নি, তখন তার অভাব ছিল সামান্য, প্রয়োজন ছিল পরিমিত৷"
খুব সহজে বলে যাওয়া চরম এক বাস্তব৷

"প্রেম ভালো, বিদ্বেষ দুঃখের কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক ইন্ডিফারেন্স- যে কাছেও টানে না- দূরেও ঠেলে না- শুধু ভুলে থাকে৷"
যাযাবর তো কাজেই মাদ্রাজি, পাঞ্জাবী, বাঙ্গালি ঘেঁটেছেন....এক চমত্‍কার কথাও বলেছেন....

"ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতাকে প্রথম বরণ করল বাঙ্গালি৷ সে যুগের বাঙ্গালির প্রাণশক্তি ছিল প্রচুর, প্রতিভা ছিল প্রখর৷ ইংরেজের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে সে গলাধঃকরণ করল না, করল গ্রহণ৷ আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জারক রসে পরিপাক করে তাকে সে আত্মসাত্‍ করল৷ পশ্চিমের চিন্তাধারাকে সে ধার করল না ধারণ করল৷ তাই বাঙ্গালীর মধ্যে সম্ভব হল মাইকেল মধূসূদন, বিবেকনন্দ ও চিত্তরঞ্জন দাশ৷"

তোফা তোফা....বেশ কিছু মানুষের জীবনের দর্শনও উঠে এসেছে তার দৃষ্টিপাতে৷ বেশ কিছু মানুষের অব্যক্ত সব কথা....এই আধারকারেরই যেমন....এবং তার সাথে বলে রাখি যদি কেহ মদিরা প্রেমী হয়ে থাকেন অথবা কৌতুহলী তবে তার জীবনদর্শনে দেখা এই আজব লোকের দর্শন পেয়ে যাবেন যার নাম রচনায় উল্লেখিত চারুদত্ত আধারকার৷ বিভিন্ন ককটেল মেকিং এর উদ্ভাবিত তার সর্ট রেসিপি৷
যেহেতু ছিলেন এক জার্নালিস্ট ঘাঁটতে হয়েছে রাজনীতি, নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরেছেন তখনকার বৃটিশ এবং ভারতীয়দের চিত্র৷ এক মজার কথা বলেছেন....ভারতীয় বিভাগে বাঙ্গালিরা অবাঞ্চিত বেশি, কেননা আর্মির "মনুসংহিতায়" বাঙ্গালিরা নাকি "হরিজন"!! এর কারণ দর্শিয়েছেন...বিংশ শতাব্দীর প্রথামাংশ থেকে এই বাঙ্গালিরাই প্রথম তেজে এবং অবিরতভাবে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করে এসেছে, স্বাধীনতার স্বপ্ন তারাই দেখেছে প্রথম৷ সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম লক্ষণও প্রকাশ পেয়েছিল বাংলাদেশের এক ছাউনিতে৷ ব্যারাকপুরে৷ সত্য।
আলোচিত সেই "ক্রিপস" আলোচনাও উঠে এসেছে তার এই রচনাটিতে৷ ব্যক্তি ক্রিপস এবং রাষ্ট্রীয় চামচা ক্রিপসকে তুলনামূলকভাবে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন৷ ক্রিপস বলেছিলেন যে...
"ভারতবর্ষের বিভিন্ন দলের মধ্যে যে প্রবল মতবিরোধ বর্তমান, একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থ ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তার একটি সমাধান করতে চেয়েছিলেন৷"

এবং লেখকের ভাষ্যমতে, শ্রোতারা বিস্ময়ে চক্ষু মার্জন করে ভাবল, এডলফ হিটলারের বক্তৃতা শুনছি না তো! তিনিও তো বলেন, তিনি চিরকাল শান্তি চেয়েছিলেন!
যাক গে, কারো কি জানা আছে..."দিল্লী দূল অস্ত" এই বিখ্যাত লাইনের কাহিনী! অতি সংক্ষেপে তবে নিখুতভাবে লেখকের কাছ থেকে জানতে পেরেছি.....এটা না পড়ে দেখে নেবেন।
"যাযাবর" ঘুরে দেখেছেন ঐতিহ্যশালী ভারতকে৷ সব উঠে না আসলেও তার দর্শনে যেমন পৃথীরাজ ছিল ঠিক তেমন ছিল আউলিয়া, মোঘল, তুঘলক, বাদশা বাহাদুর শাহ ও সাজাহান৷ সাজাহানের আদরের দুহিতা জাহানারা৷ জাহানারা ছিলেন ফকির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার একজন বড় ভক্ত এবং তার সমাধি যেন তাঁর পাশেই হয়, এই ছিল তার ইচ্ছা৷ হয়েছেও তাই...উনি তার সমাধি বাহুল্যবর্জিত চেয়েছিলেন...তাই রমজানের কোন পুণ্য তিথিকে তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তার সমাধি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পাশেই করা হয়৷ এবং সম্পূর্ণ বাহুল্যহীন যেখানে উনার নিজেরই লেখা কবিতা স্থান পেয়েছে....

"বেগায়র সবজা না পোশাক কসে মাজারে মারা,
কে কবর পোষে গড়িবান হামিন্ গিয়াহ বসন্ত৷"



-একমাত্র ঘাস ছাড়া আর কোন কিছু যেন না থাকে আমার সমাধির উপরে৷ আমার মত দীন দরিদ্র অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন৷




**সব মিলিয়ে সঙ্গত কারণেই আমি বলব বইপ্রেমীদের কালেকশনের প্রথম পর্যায়ে অবস্থান করবার যোগ্যতা যথার্থই "দৃষ্টিপাত" এর আছে। আর কে এই "যাযাবর"!!
"বিনয় মুখোপাধ্যায়" যাঁর আরোও এক ছদ্মনাম রয়েছে..."শ্রী পথচারী"।

বুধবার, ১৮ জুলাই, ২০১২

মেমসাহেব....ও মেমসাহেব....


There are two tragedies in life.
One is to lose your heart's desire,
The Other is to gain it.
-G. B. S.
কিছু কিছু বই থাকে যা নতুন করে হাতে নেয়া মানেই,টিস্যু পেপারের বক্স সামনে রাখা। হাসির মনে হলেও ঘটনা কিন্তু সত্যি। আমার ক্ষেত্রে সেরকম কালেকশনগুলোর মাঝে উপরের পর্যায়েই আছে...এই "মেমসাহেব"। প্রেম প্রেম কাহিনী আমার খুব যে ভালো লাগে তা নয় বরং উল্টোটাই হয়। কিন্ত "মেমসাহেব"!! আমার কাছে অসাধারণ ছিল,আছে এবং থাকবে।
যখন পড়ছিলাম প্রথমবার নিজেকে নিমাইয়ের পাঠক বলেই মনে হয়েছিল...কিন্তু পরের বার মনে হলো ওর দৌলাবৌদি যেন আমিই। আঁচল দিয়ে চোখের কোণ মুছে পড়ছি এক পাগলের প্রলাপ। চোখ পরিস্কার করার জন্য এর চেয়ে মোক্ষম মেডিসিন আমার কাছে আর কি হতে পারে! "মেমসাহেব.. মেমসাহেব"... অস্ফুট আওয়াজে আনমনে আমিও যেন কখন ডেকে উঠি!
আপন মনে আমি ভেবে যাই আর নিজেকেই প্রশ্ন করতে থাকি....
ওর "বিশ্বাস" নাকি "আত্মবিশ্বাস"!!
"আমাদের দেখা হবে,একথা আপনি জানলেন কি করে?
-কি করে জানলাম তা জানি না,তবে মনের মধ্যে স্থির বিশ্বাস ছিল যে আপনার সঙ্গে দেখা হবেই।
-শুধু মনের বিশ্বাস?
-হ্যাঁ।"
পাগলের কি কথা!!
"সব মেয়েদের মনেই ঐ এক ভয়,এক সন্দেহ,কেন বলতে পারো?পৃথিবীর ইতিহাস কি শুধু পুরুষদের বিশ্বাসঘাতকতার কাহিনীতেই ভরা?"
তা কেন হতে যাবে রে বোকা!
ওমনই যদি হতো...তাহলে এটা তো আর বলতে পারতে না....
"মহব্বত জিসকো দেতে হ্যায়,
উসে ফির কুছ নেহি দেতে।
উসে সাব কুছ দেতা হ্যায়,
জিসকো ইস কাবিল নেহি সমঝা।
- জীবনে যে ভালোবাসা পায়,সে আর কিছু পায় না;যে জীবনে আর সবকিছু পায়,সে ভালোবাসা পায় না।"
নিজের জীবনের অপর নামই যার নাম তাকে নিয়ে যে কোন বর্ণে আঁকা সহজ নয়,তা জানি...আরোও টের পেলাম তোমার আকূলতায়...হাহাকারে....
"তোমাকে আমি বোঝাতে পারব না,লিখতে পারব না,আমার মেমসাহেবের সবকিছু। জানাতে পারব না আমার মনের ভাব,ভাষা,অনুভূতি।"
"একজনকেও পেলাম না যে আমার কাছে আমার মেমসাহেবের স্মৃতি ম্লান করে দিতে পারে।"
কী করে পারবে কেউ ম্লান করে দিতে তোমার মেমসাহেব কে!! এতই সহজ!! আমিও ভাবি....
"আমি জানি তুমি আর কাউকে কোনদিন ভালবাসতে পারবে না।
-জানো?
-একশ'বার,হাজারবার জানি।
-কেমন করে জানলে?
-সে তুমি বুঝবে না?
দৌলাবৌদি,তুমি তো মেয়ে। তাই বুঝবে কত গভীরভাবে সারা অন্তর দিয়ে ভালবাসলে এসব কথা বলা যায়।"
যখন কাউকে খুব করে চাওয়া হয়...তখন তার কথা কাউকে বলতে গেলে মন আপনাতেই কখন যেন তার কাছে চলে যায়৷ তার সেই মুখের হাসি চোখে ভাসলে একাই হাসি আসে, কখনো বা লজ্জা লাগে...এক পার্থিব ভালোলাগায় মনটা ভরে যায়৷ দিন, কাল, পাত্র সব ফিকে হয়ে, ফেলে আসা অতীত বাস্তব হয়ে দাঁড়ায়৷ হয়ত একমাত্র এভাবেই মানুষ অতীতকে ফিরে পায়!! আমার বড় ভুল হয়েছে...কেন যে জানতে চাইছিলাম৷ কতটা কষ্টই না হয়েছে তোমার, কতটা দগ্ধই না হয়েছো বারে বারে....

"এই চিঠি লিখতে বসেই আবার মনের রিভলবিং স্টেজ ঘুরে যায়, দৃশ্য বদলে যায়৷ আমার চোখটা ঝাপসা হয়ে উঠে৷ কলম থেমে যায়৷ একটু পরে দুচোখ বেয়ে জল নেমে আসে৷"
পাগলগুলো... কেন ওতো ভাবতে যেতে!! তোমাদের মন, কি এতটাই সমর্পিত ছিল যে ভূতভবিষ্যত পর্যন্ত দেখতে, বুঝতে পেত! যার জন্যে বারে বারে ওমন কেঁপে ওঠতো!!

"জীবনে চলতে গিয়ে বার বার পিছনে পড়ে গেছি৷ তাই তো ভবিষ্যতেরর কথা ভাবতে, ভবিষ্যত্‍ জীবনের স্বপ্ন দেখতে ভয় হয়৷
ও হাত দিয়ে আমার মুখটা চেপে ধরে বললো- না না, ভয়ের কথা বলো না৷ ভয় কি?
একটু আতঙ্কে, একটু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জানতে চাইল, - আমি কি তোমার হবো না?
এবার আমি ওর মুখটা চেপে ধরে বললাম- ছি ছি, ওসব আজেবাজে কথা ভাবছ কেন? তুমি তো আমারই৷"
এটা তো সত্য ভালোবাসায়.. সেটা যে সম্পর্কের সাথেই হোক না কেন...তা যদি টিকে তবে শুধুমাত্র "শ্রদ্ধাবোধ" এর শক্তিতে...এই একটা জোরেই টিকে যায় সম্পর্ক। তুমি জানতে, বুঝতে সেটা.. আর তাই বললে..
মেমসাহেব শুধু আমাকে ভালবাসত না, শ্রদ্ধা করত, ভক্তি করত। সোনায় যেমন একটু পাত মিশিয়ে না নিলে গহনা মজবুত হয় না, সেই রকম ভালবাসার সঙ্গে একটু শ্রদ্ধা, ভক্তি না মিশালে সে ভালবাসাও দীর্ঘস্থায়ী হয় না।
মেমসাহেবের কথা আমাকে যতই জানাচ্ছিলে ততই বুকের ভেতর চাপে অস্থির হয়ে ছটফট করছিলাম দম নেবার জন্যে, আর যখন তোমার সেই মেজদিদি এসে জানালো যে............................
আমার নি:শ্বাস ক্ষণিকের জন্যে আটকে গিয়েছিলো। নাহ সে বর্ণনা পুনরায় আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। কারণ আমি যে তুমি না!
তুমি কিভাবে আছো বেঁচে....??
নিদ আয়ে তো খোয়াব আয়ে,
খোয়াব আয়ে তো তুম আয়ে।
পার তুমহারি ইয়াদ মে,
না নিদ আয়ে না খোয়াব আয়ে....।
গজাননটাও কত পাগল হয়েছে তোমার সাথে!! সেও পর্যন্ত মুখে আনে না একটিবার তোমার বিয়ের কথা!! ঘর বাঁধবার কথা!! ঘর তো বেঁধেছোই...তোমার বিশে ফাল্গুন, ৬ই মার্চ এ..তোমার মেমসাহেবের দেয়া ধুতি-পাঞ্জাবী পরে। তোমার চোখের জল মুছতে মুছতে তোমার মেমসাহেবের ছবিতে মালা চড়িয়ে...সিঁদুর পরিয়ে।
তোমার চিঠি শেষ করলে...

"Time marches on but
memories stays.
Torturing silently the rest
of our days"
সেই স্মৃতির জ্বালা বুকে নিয়েই বোধহয় আমার বাকি দিনগুলো কাটবে। তাই না?


**জানি না বাচ্চুর দৌলাবৌদি চিঠি শেষ করে কি করেছিল! হয়তবা অঝরে কেঁদেছে..হয়তবা নিজেকে কষেছে!!...কিন্তু আমি দেখি... এক প্রচন্ড হাহাকার বুক জুড়ে...বোবা কান্নায়, অসহনীয় কষ্ট নিয়ে আমার রাত কখন যেন পেরিয়ে গেছে। অনেকদিন পর এটা হাতে নিয়েছিলাম..ভেবেছিলাম শুধুই পড়ব...কিন্তু একবার ভাবিনি একে ঘিরে থাকা সেই অনুভূতি... আজোও এতটুকুও বদলায় নি। তাই এই স্মৃতিচারণ "বাচ্চুর" উদ্দেশ্যে।

শনিবার, ১৪ জুলাই, ২০১২

হাজারি ঠাকুরেরই....."আদর্শ হিন্দু হোটেল"


নাহ....কখনো কখনো ভাবি যদি ফিরে যেতে পারতাম অতীতের দিনগুলিতে!! পেরিয়ে আসা সময়গুলোর মাঝের কোন একটা দশকে যদি জন্ম নিতাম!! "সততা" এখন শুধুই অতীতেরই ফ্রেম।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তো আর নতুন করে চেনাবার কিছু নেই, বাংলা সাহিত্যের উঁচু পর্যায়ের লেখক, (সেপ্টেম্বর ১২, ১৮৯৪ ইং - নভেম্বর ১, ১৯৫০ ইং সাল) "আদর্শ হিন্দু হোটেল" তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি। সম্ভবত "আরণ্যক" প্রকাশের পর, ১৯৪০ইং সালে এটি প্রকাশিত হয়। সততার কথা টেনে আনা...কারণ যে সময়কার চিত্রপটে লেখা তাঁর এই উপন্যাস সেখানে সততা যে কত বড় শক্তি তা প্রতি মুহুর্তে টের পাচ্ছিলাম, পাতাগুলো উল্টাবার সময়। দেখছিলাম...মানুষগুলো কত সৎ!! হিংসার জলন্ত আগুন যদিও দেখেছি কিন্তু তবুও শেষ অব্দি সততার বলয়ে তার নতুজানু হবার "সত্য"টাকেও দেখেছি।

প্রতিটি চরিত্রই তাদের ভিন্ন ভিন্ন সত্তা নিয়ে আলোকিত যদিও কাহিনীর নায়ক একজনই....আমাদের বুড়ো নায়ক। প্রেমে পড়ার মতন নয়...ভালোবাসার মতন, শ্রদ্ধা করার মতন একজন অতি সাধারণ হাজারি চক্রবর্তী, রসুয়ে বামুন ঠাকুর। যার হাতের রান্নার সুখ্যাতি সবার মুখে মুখে, এ যেন ঈশ্বরের আর্শিবাদ, আমার তো মনে হয় ভগবান এতটাই তৃপ্ত যে হাজারি ঠাকুর স্বর্গে গেলে বলবে..."ঠাকুর, একটু রেঁধে খাওয়াতো দেখি!" যাক গে, বই পড়বার এই মুসকিল! প্রকৃতির স্বাদ চোখ বুজে যাও অনুভব করা যায়...যদি কোন রান্নার অতুলনীয় বর্ণনার কাহিনী পড়া হয়, তবে তা পেটে আগুন লাগানো ছাড়া মনে হয়না আর কোন অনুভূতি জাগাতে পারে..(ক্ষণে ক্ষণে সুরঞ্জনাদি এবং উদারজী ভাইয়ের উদার রান্নাঘরের ছবি মনে ভাসল, যদিও তাদের হাতের রান্নার স্বাদ নেয়া হয়নি) যাহ, কি লিখতে গিয়ে কি লিখছি...লোভী রুপ বের করে ফেলছি..
আক্ষরিক অর্থে আমার সবচাইতে ভালো লেগেছে...ফাটাফাটি বলে যাকে "পদ্মা ঝি" কে। জীবনের উন্নতিতে এদের মত চরিত্রের অবদানটাই কিন্তু বেশি, যদি এদের মুখ নিসৃত: বাণী ভালো করে কেও গায়ে লাগায় তো! প্রথমেই মুখ নিসৃত: বাণীর একটিতে খুব মজা পেয়েছিলাম...

"পোড়ারমুখো মিনসে আবার শুনতে না পায়। কি যে ওর রান্নার সুখ্যাত করে লোকে, তা বলতে পারি নে- কি এমন মরণ রান্নার!"
বোঝাই যাচ্ছে...উপনাস্যের ভিলেনের চরিত্র ৮০% এই পালন করছে!

রাণাঘাটের রেলবাজারে বেচু চক্রবর্তীর খাবারের হোটেলের সেরা রাধুনী হাজারি ঠাকুর, যদিও নুন্যতম সম্মান তার মালিক তাকে কখনোও দেন নি বরং ঝেড়েছেন কখনো কখনো পদ্ম ঝির উস্কানিতে। তবে তা পুষে গিয়েছে যখন খদ্দেররা বলেছেন...
"সেই বামুন ঠাকুরকে দিয়ে রান্না করানো চাই। নইলে আমরা অন্য জায়গায় যাব।"

পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি একজন রাধুনীর এই কথাতেই হয়ে যায়। কিংবা যখন মালিকের ব্যবসায়ীক প্রতিদন্দ্বী তাকে বেশি বেতনের চাকুরী দেবার প্রস্তাব দেয়!

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হাজারি ঠাকুর ও সাথের কিছু চরিত্রের সরলতায় তৈরি একটা আত্মবিশ্বাসের শক্তি, কখন যেন আমি নিজেও অনুভব করলাম। বিশ্বাস দৃঢ় হলো, একজন মানুষ নিজের কাজের প্রতি যদি নিজে বিশ্বাস রাখে, সততার আবরণে বিশ্বাস রেখে যদি পথে নামে...গন্তব্য নিজেই কাছে চলে আসে। যদিও আজকালের বাস্তবতার খাতিরে সঙ্গায় একটু যোগ করতে হবে যে, সততার চাদরটিতে বুনতে হবে....একটু টেকনিকের ডিজাইন..(টেকনলজির যুগ যে!!)
দাগ কাটা চরিত্রগুলি...রতন ঠাকুর, বংশী, কুসুম, পাড়াগায়ের কায়স্ত ঘরের এক অল্প বয়সী বধু (যার সরলতা অদ্ভুদ)।
আর ব্যক্তিগতভাবে প্রেমে পরেছি অতসীর। বিভূতিবাবু যে তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন সে থেকে নয়...প্রেমে পড়েছি...তার অমায়িকতায়, বাহুল্যহীনতায়। কেমন যেন এক স্নিগ্ধতার আবেশ তার কথায়, উপস্থিতিতে...যদিও শেষে তার পরিনতি কষ্ট দিয়েছে, প্রশ্ন করেছিলাম কি দরকার ছিল তার অমন পরিনতির!!
আরোও একজন আছে, হরিচরণ বাবু, অতসীর বাবা। তার এক উক্তি...খুব বেজেছিল বুকে...

"উদ্যমই জীবনের সবটুকু। যার জীবনে আশা নেই, যা কিছু করার ছিল সব হয়ে গেছে- তার জীবন বড় কষ্টকর।"

নদীর ধারে ফাঁকা এক জায়গা হাজারি ঠাকুরের চিন্তার, আমার কাছে ধ্যান করার মতই স্থান। কেননা, এই জায়গাতেই সে স্বপ্ন দেখেছে...স্বপ্ন বুনেছে হাজার। স্বপ্ন দেখেছে তার নিজের হোটেলের..."হাজারি চক্রবর্তীর আদর্শ হিন্দু হোটেল"। যেখানে খদ্দেরের সাথে কোন প্রতারণা হবে না। পয়সা দিয়ে তারা খাবে, তৃপ্তি করে খাবে। খাওয়ার পর যেন বলতে পারে...পয়সা উসুল হলো। কারণ সে বুঝেছিল...
"পরের তাঁবে কাজ করিলে মানুষকে দয়া মায়া বিসর্জন দিতে হয়।"

বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় খুব গভীর জীবনবোধের তেমন কোনকিছু না থাকলেও....স্বপ্নের মত জীবনের এক একটি ধাপ ছিল, কিন্তু অবশ্যই সাধারণের বাস্তবজীবনের আঙিকেই।
হুমম...বইয়ের শেষ পাতা উল্টে আবিস্কার....আমি আপন মনে কখন যেন হেসেছিলাম! হতে পারে...পদ্ম ঝিয়ের কর্মে....

"ঠাকুর মশাই, পায়ের ধুলোটা দেন একটু।"

মঙ্গলবার, ৩ জুলাই, ২০১২

শোশা....is a haunting rather than a novel...


"মানুষের যন্ত্রণার শেষ আমি দেখতে পাই না। যখনই একটা যন্ত্রণার শেষ হচ্ছে বলে মনে হয় তখনই মানুষ নতুন যন্ত্রণাকে আবিস্কার করে বসে এবং এভাবেই তা চলতে থাকে এক অনি:শ্বেষ প্রবাহের মত। কষ্ট,যন্ত্রণা,বেদনাভোগই আমার পাত্র-পাত্রীদের পরিণাম।"



আইজাক বাশেভিস সিঙার (জন্ম নভেম্বর ২১,১৯০২ইং - মৃত্যু জুলাই ২৪,১৯৯১ইং) একজন মার্কিন কথাসাহিত্যিক হলেও জন্মসুত্রে পোলিশ। ১৯৭৮ সালে সাহিত্যে লাভ করেন নোবেল পুরস্কার। তিনি মূলত সাহিত্য রচনা করেছেন ঈডিশ ভাষায়। নোবেল বক্তৃতায়,ঈডিশ ভাষাকে বিশ্বসাহিত্যের ভিটামিন বলে অভিহিত করেন। ঈডিশ ভাষায় নির্মিত সাহিত্যকর্মগুলো এতো গুরুত্বের দাবীদার এই জন্যে,যে ভৌগলিক সীমানায় এ ভাষার উদ্ভব,সেই ভৌগলিক সীমানাই আজ ঐতিহাসিকভাবে বিলুপ্ত। বলা চলে আজ এটা একটি অ্যান্টিক ভাষা। ঈডিশভাষী আজ বিলুপ্তপ্রায় অপমৃত্যু ও দেশত্যাগের কারণে। বর্তমানে এই জনগোষ্ঠী মার্কিন যুক্তরাস্ট্র,ইজরায়েল ও ইউরোপে আজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।




এই উপন্যাসটি কোনভাবেই হিটলারপূর্ব বছরগুলিতে পোল্যান্ডের ইহুদিদের প্রতিফলন নয়। এটি হচ্ছে অনন্যসাধারণ পরিস্থিতিতে থাকা অনন্যসাধারণ কিছু চরিত্রের গল্প।- Issac Bashevis Singer


সিঙারের বেশিরভাগ সাহিত্যেই কোথাও না কোথাও তার নিজের আত্মকাহিনী খুঁজে পাওয়া যায়,ব্যাতিক্রম এই "শোশা"ও নয়। ব্যক্তিগত জীবনে সিঙার "শোশা"র নায়ক এ্যারনের মতই। এ্যারনের জীবনের যেমন বহু নারীর বিচরণ দেখা যায়,সিঙারের জীবনেও দেখা যায়,যা অকপটে নিজের ছেলে ইজরায়েল জামির কাছে সে স্বীকার করে।
"শোশা" তে মূলত প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কাহিনী ফুঁটে উঠে,যেখানে ইহুদিঅধ্যুষিত পোল্যান্ডের একটি স্থান ক্রোখমালনাকে... খুঁজে দেখা যায়। দেখা যায় এখানকার পারিবারিক ও সামাজিক জীবন। দেখা যায় বিচিত্র মানুষ ও তাদের সমাজ ব্যবস্থা। যেখানে পরিবেশ উৎসবমুখর,সংস্কারে বিশ্বাসী আবার আছে অপেক্ষাও। কেউ অপেক্ষা করছে ত্রানকর্তা তাদের উদ্ধার করবে অনাচার থেকে...কেউ অপেক্ষা করছে কখন তারা হিটলারের শিকারে পরিণত হবে। সিঙার "শোশা"তে ইহুদি জাতিকে এমনভাবে দেখিয়েছে যারা বিভিন্ন প্রাচীন প্রথায় নিজেদের আটকে রেখেছে,সমস্ত জানালা-দরজা বন্ধ করে কেবল স্বর্গ নরকের হিসেব নিকেশ করে,যাদের কোন প্রসারতা নেই। "শোশা"র নায়ক এ্যারন বলে...

নয়শ বছর ধরে পোল্যান্ডে বসবাস করেও ইহুদিরা পোলিশ হতে পারে নি...তারা ইহুদিই।
"শোশা" তাদের কাহিনী যারা যুগ যুগ ধরে পোল্যান্ডবাসী অথচ তারা জন্ম থেকেই বিচ্ছিন্নতাবোধে আক্রান্ত। যাদের চোখে শুধু পবিত্র ভূমির স্বপ্ন।
সমালোচক মহলে আইজাক সিঙার একজন রহস্যময় মানুষ যিনি পুরোপুরি ধার্মিক নন আবার ধার্মিকও। কখনো কখনো তাকে তার বাবার মত গোঁড়া ধার্মিক বলে মনে হয় আবার কখনো কখনো তার ভাই জশুয়ার মত উদার।
"শোশা"তে এক জায়গায় সিঙার বলেছেন...

"সব মানুষই আনন্দবাদী। দোলনা থেকে সমাধি পর্যন্ত সবাই কেবল আনন্দের কথা ভাবে। ধার্মিকেরা কী চায়?অন্য লোকে গিয়ে আনন্দ। সাত্ত্বিকেরা কি চায়?আধ্যাত্মিক আনন্দ বা কিছু একটা। আমার লক্ষ্য আরোও দূরে। আমার মতে,আনন্দ কেবল জীবনেই ঘটে না,ঘটে সমগ্র বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডে। স্পিনোজা বলেন,ঈশ্বরের দুটো বিশেষত্বের কথাই আমরা জানি- চিন্তা ও বিস্তার। আমি বলি ঈশ্বর মানে আনন্দ। আনন্দ যদি একটি সত্তা হয় তবে অবশ্যই এটা গঠিত অনন্ত ভাবের দ্বারা। এর মানে এখনও অগুনতি অজানা আনন্দ আবিস্কারের অপেক্ষায় আছে।"

"আমি ধার্মিক আমার নিজের ধরনে। আত্মার অমরতায় আমি বিশ্বাস করি। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পাষাণ যদি টিকে থাকতে পারে,তাহলে মানবাত্মা কিংবা যা খুশী নাম দাও এর,কেন ধ্বংস হয়ে যাবে?আমি তাদের সঙ্গে আছি যারা মৃত। আমি তাদের সঙ্গে বসবাস করছি। যে মুহুর্তে আমি চোখ বন্ধ করছি তারা সবাই আমার সঙ্গে আছে। আলোর রশ্মি যদি কোটি কোটি বছর ধরে ভ্রমণ ও বিকিরণ করতে পারে তো আত্মা পারবে না কেন?"

"শোশা"তে এক জায়গায় বলতে দেখি....
"মানুষ নিজে নিজের যতটা ক্ষতিসাধন করে কোন শত্রু তা করতে পারে না।"

হয়তবা এর জনেই অন্য জায়গায় এক জনের বিলাপ কানে আসে.....

"মানুষ কী করতে পারে?মানুষ বাঁচে কীভাবে?"

Isaac Bashevis Singer begins with a disconcerting irony: "I was brought up in three dead languages - Hebrew, Aramaic, Yiddish." This ironic statement functions as an invocation of those dead who spoke, specifically, the Yiddish of Poland. He invites us to a seance to hear their voices; Shosha is a haunting rather than a novel.


** "শোশা" প্রথম প্রকাশিত হয় ঈডিশ ভাষায় ১৯৭৪ইং সালে এবং এর ইংরেজি অনুবাদ প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৭৮ইং এ।

মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১২

জননী.....A novel of Motherhood.....


অভাব অনটনের, না পাবার কালো ছায়ায় অভিশাপ থেকে, হাজারো দূরে বসে মর্ডানাইজড সভ্যতার সুফলগুলো নিয়ে বাস করা যেমন বাস্তব, ঠিক তেমনি উত্তপ্ত রবির পরশে শরীরের নোনতা তরল নিঃসরন, হাঁড়কাপা শীতকে পাতলা চাদরে বাগে আনা, কখনো বা একবেলা, একমুঠোয় পেট পূজা, কখনো বা তাও না....এটাও বাস্তব৷ বাস্তব রুঢ়ও যেমন, প্রহসনও তেমন৷ বাস্তব শুধুই নিষ্ঠুর...এমনটা ভাবা সেঁকেলে টাইপ একপেশে মন্তব্য৷ বাস্তব....তোমার আমার মিষ্টি কথোপকথন...চায়ের কাপে টোকা মেরে তুমুল আড্ডা বন্ধুদের সাথে, দূরে কোথাও প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়া৷ বাস্তবতো এটাও..তাই না!!

এতো বাজে বকছি...কারণ, "নাই কাজে খই ভেজেছি" এখন সার্ভ না করা পর্যন্ত মনশান্তি যাকে বলে ঠিক পাচ্ছিনা৷ ভালোই ছিলাম...কিন্ত পেপারটা হাতে নিয়ে সিরিয়াতে ফেলা দু'তিনটা বোমা ফেলা এবং এতে কতক "মুক্তির শেষ শান্তির নিঃশ্বাসত্যাগকারীদের!!!" কথা একদম পানসে করে দিল মন৷ সভ্য দু'একটা ভাষা মানে শব্দ উচ্চারণ করতে করতে "মরার উপর খারার ঘা" মারলাম "জননী" বইটি হাতে নিয়ে৷ শতকত ওসমানের লেখা৷(ছদ্ম নাম শওকত ওসমান, প্রকৃত নাম হচেছ, শেখ আজিজুর রহমান। জন্ম ১৯১৭- মৃত্যু ১৯৯৮ইং ) ইতোমধ্যে অনেকেই জানেন হয়ত...পড়েছেনও৷ বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক।

মনটাকে বিক্ষিপ্ত করে দেবার সকল আয়োজন হয়ে গেল৷ এই বইটি উপহার দিয়েছিলাম এক অগ্রজকে, পড়তে এনেছিলাম..৷ সখ করে শুভেচ্ছাবাণী হিসাবে লিখেছিলাম "জন্ম তব হোক সার্থক"৷ পদে পদে এখন বুঝছি...সার্থকতার সংগা এখন বিভিন্ন....তবে কোন সঙ্গায় সঙ্গায়িত করব এই জন্ম কে!! নাহ...আবারো খেই হারাচ্ছি৷ এই কোহিয়েরেন্স মেইনটেইন করা দেখি আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভবকর হচ্ছে না!!
যাক্ গে..."জননী" নিয়ে কোন রিভিউ লিখতে যাচ্ছি না৷ আগেই বলেছি...এটা নিতান্তই সাধারণের দৃষ্টি৷


"জননী" তিনটি অক্ষর যার গাঁথনি..."মা" এখানে তো মাত্র একটি৷ কিন্তু মর্মার্থও কি এতো হালকা..সহজ!! এই উপন্যাসটির নামকরণ বড় সার্থক৷ এর পাতায় পাতায় যে জীবনের চিত্র অঙ্কিত...সেখানে ভাঁজে ভাঁজে...গ্রাম্য মায়ের ভালোবাসার হাজারো রঙ৷ কখনো কষ্টের, ভালোবাসা, আনন্দের৷ কখনো শাষন, তীরস্কারের, কখানো আশ্রয়, প্রশ্রয়ের৷ অবশ্য আরোও অনেক জীবনের কাহিনীও বর্ণিত৷

মূল চরিত্রগুলো... এক স্বার্থহীন জননী দরিয়াবিবি, একদা সম্বান্ত পূর্বপুরুষদের বংশধর হতদরিদ্র নিঃস্ব চাষী আজহার, দুরন্ত আবেগী আমজাদ (দরিয়াবিবির ছেলে), পাগলা চন্দ্র, যে জানে অসহ্য ব্যথায় হাসতে৷

আরোও কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র আছে...দরিয়াবিবির প্রথম ঘরের সন্তান মোনাদির, আশেকজান, হাসুবৌ, শৈরমী, এলোকেশী, আমেরন চাচী, লম্পট অথচ যত্ন ও শান্তির কাঙ্গাল ইয়াকুব৷ মনে একদম...ছুরি বসিয়ে দাগ কাটা যাকে বলে...সেরকম কিছু দৃশ্যের কথা বলছি....

উপন্যাসটির এক জায়গায় বৃদ্ধা সহায়-সম্বলহীন অন্যের দখ্যিনায় দিনযাপনকারী আশেকজানের প্রতিবিম্বকে দরিয়াবিবির দৃষ্টির দ্বারা পাকা হাতে দেখিয়েছেন শওকত ওসমান৷

"দারিদ্র্যের নারী-প্রতীক যেন ওই গৃহকোণে আশ্রয় লইয়াছে৷ আল্লাহর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জীবন৷ এই তার পরিনতি! দরিয়াবিবি অসোয়াস্তি অনুভব করে৷ দারিদ্র্যের দাবানলে সংগ্রাম বিক্ষুদ্ধ জীবনের সমগ্র ঐশ্বর্যসম্পদ ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছে৷ লোলচর্ম কোটরাগত চক্ষু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে মানুষের আত্মার দিকে চাহিয়া আছে মাংসলোভী কুকুরের মত৷" 

দরিয়াবিবির সংসারের চিত্র দিনকে দিন খারাপের দিকে আর এরই মাঝে আজহার ভাগ্য অন্বেষনের দায়ে পাড়ি জমায় ভিন্ন জায়গায়, শহরে৷ দরিয়াবিবিকে সংসারের পেট চালাবার দায়ে ছোট্ট আমজাদের ঘাড়ে দায়িত্বের বোঝা ফেলতে হয়৷ যার লেখাপড়া নিয়ে ছিল হাজারো স্বপ্ন...."তুমি কি আর স্বপ্ন দেখো না দরিযাবিবি?" প্রশ্নটা কাকে করা??

ভিন্ন ধর্ম...তবুও এদের সম্পর্ক যেন হৃদয়ের....চন্দ্রের সাথে আজহারের, দরিয়াবিবির সাথে শৈরমী৷ একসময় প্রচন্ড বাধ্য হয়ে পিতলের ঘড়া বন্ধকের জন্য শৈরমীর শরোনাপন্ন হয়...দরিদ্র কিন্তু শক্ত ব্যক্তিত্বের দরিয়াবিবি৷ যে কিনা দান দখ্যিনার ছায়া থেকে নিজের মান বাঁচিয়ে চলে৷ সেই শৈরমীর শেষ নিঃশ্বাসত্যাগের সময়...শরা-শরিয়তের বেড়ি বাধা পোয়াতি দরিয়াবিবি, রাতের আঁধারে স্বামীর অগোচরে তাকে দেখতে যাবার সাহস কোথা থেকে পায়!! এ কেমন টান!!

" রক্তমাংসের নিচে মানুষে মানুষে সঙ্গীভূত হওয়ার যে পরিপ্লাবী উত্‍সধারা যুগ-যুগান্তের শিকড় উত্‍পাটন করিয়া নব নব সভ্যতার বীজ ছড়াইয়া যায়- তারই সর্বস্বীকারহীন চঞ্চল আর্তনাদ তরঙ্গের মতো দরিয়াবিবির বুকে আছড়াইয়া পড়িতেছিল৷ তারই আহবান তো এতো নিশীথ রাত্রে ঘরছাড়া করিয়া আনিয়াছে তার মতো গর্ভবতী জননীকে৷" 

অবশ্য পেটের এই সন্তানটির নাম শৈরমীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য রাখা হয়...শরীফন, ডাক নাম শরী৷
"শৈরমীর স্মৃতি একবার তার মনে জাগিয়াছিল বৈকি৷ সেই দীন-জীবনের করুন অবসান-মুহূর্ত! ডাক নামে শৈরমীর স্মৃতি বাঁচিয়া থাকে৷ দেশের বিশাল মানচিত্রের এক কোণে নামহীন গ্রাম্য জননীর দীন প্রচেষ্টা-জাতি-ধর্ম যেখানে মানবতার উপর নৈরাজ্যের কোন ফণা মেলিতে পারে না৷" 

এই "ডিভাইডেট রুল"...কাল সাপের ন্যায় সব শতাব্দীতেই কি পিছু পিছু চলবে আমাদের...মানবসভ্যতা টিকে থাকবে যতদিন!! মহেশডাঙার হতদরিদ্র মানুষগুলোর...দাম্ভিক, ক্ষমতালোভী কিছু পশুদের খেলার পুতুল হবার খানিক দৃশ্যও এই উপন্যাসে অঙ্কিত..সঙ্গতকারণে৷ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা৷ যেখানে বিভ্রান্ত হয় ক্ষণিকের জন্য চন্দ্রের মতো মানুষও, তবে নির্বিকার সহনশীলতা দেখায় আজহার৷ কিন্তু এই ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষটিও বড্ড খেপে যায়, যখন নিজের ধর্ম নিয়ে কথা উঠে৷ হিংস্ররুপটির পরিচয় ঘটে লা-মজহবী আর হানাফীদের কলহের সময়৷
তবে এখানে চন্দ্রের স্ত্রী এলোকেশীর ভাবনাগুলো চন্দ্রের মতো ঘোর লাগানো নয়৷ আজহার যখন চন্দ্রের সাথে দেখা করতে যায়..চন্দ্র নির্বাক থাকে৷ এড়িয়ে যায় আজহারকে৷ সেখানে এলোকেশী বলে...

"লোক এল, কথা বল৷ গাঁয়ে হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া তো ভাইয়ের সঙ্গে কী৷ যতসব অপসিষ্টি, হতচ্ছাড়া লোক৷"

যত বড় বড় দাঙ্গা হয়েছে...তাতে ঘর কোন নেতাদের, দাঙ্গা সৃষ্টিকারী, উত্‍সাহকারীদের পোড়েনি...আগুন কোন ক্ষমতালোভীদের আঙিনায় জ্বলেনি৷ জ্বলেছে...সাধারণ, অসহায় মানুষদের৷ ঘর, ইজ্জত, মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশেছে সাধারণদের...যারা শান্তিপ্রিয়৷ কাছের হতদরিদ্র বন্ধু শিবু আর ইসমাইল যখন এই দাঙ্গার কারণে মারা যায়, তখন বোধদয় ঘটে চন্দ্রের৷
আত্মভোলা, নিঃস্বার্থ মানুষটি গেয়ে উঠে-

"ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা, ও তোমার মাথায় ঝাঁটা৷
যে চেয়েছে তোমার দিকে, তারই চোখে লঙ্কা-বাটা৷
ও ছড়িয়ে দিলে, ছড়িয়ে দিলে, মারলে তারে তিলে তিলে,
ও আমার বৃথা ফসল কাটা, ও তোমার মাথায় ঝাঁটা৷"

তার এই বোধদয়ের কারণ আজহার যখন জানতে চায়...অশ্রুর ফোঁটা ফেলে চন্দ্র বলে-
"ওদের বাড়িতে কি কান্না৷ শিবুর বৌ ছেলেপুলে নিয়ে হয়ত না খেয়ে মরবে৷ রোহিণী আর হাতেম শালার কি আসে যায়৷ আমার চোখ খুলে গেছে কাল সদরের হাসপাতালে৷"

বুদ্ধিহীন, অন্ধ, অশিক্ষিত-শিক্ষিত গোঁড়া, দরিদ্ররাই সব সময়ই হাতের খেলনা হয়...রোহিণী আর হাতেমদের মতো ক্ষমতালোভী কুকুরদের৷ দাঙ্গায় রক্তের গঙ্গা তাদেরই বয়ে যায়৷ লোভী কুকুরদের একটা চুল পর্যন্তও বাঁকে না৷

"জননী"র প্রধান চরিত্রই কিন্তু দরিয়াবিবি...তাকে যতটুকু যেভাবে আমার বোঝার দরকার...বুঝে নিয়েছি৷ কিন্তু কিছুই লিখতে পারছিনা তাকে নিয়ে!! কেননা মনে হচ্ছে.. ফাঁক থেকে যাবে৷ লিখতে পারবোনা৷ এটা পাঠকদের বুঝতে হবে৷ এ এতো গভীর, যে ডুব দেয়া আমার মতো নগন্যের পক্ষে সম্ভব নয়৷ কি বলব....এই জননীকে নিয়ে?? যে জননী... সন্তানদের বুঝতেও দেয় নি, অন্নের ভাগ তার নেই! যে জননীর দিন শুরু হয় এই চিন্তা করেই যে সন্তানদের মুখে কি তুলবে...সংসারে শ্রী আদৌও আনা যাবে কি না! আর রাত কখনো কখনো নির্ঘুম!! যে জননীর কপালে একটু জিরিয়ে নেবার সময়টুকু হয় না, কপালে জোটে না আঁতুর ঘরের বিশ্রামটুকুও!! যে শক্ত কঠোর, আপোসহীন জননী, সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে পেটের দায়ে, দয়া দখ্যিনার চাল গ্রহণ করে...যা ঘৃণাভরে এতোদিন প্রত্যাখান করেছিল! যে জননী, স্বামীর মৃতু্যর পর সহায় সম্বল হারিয়ে, অকূল সাগরে ভেসে থাকবার জন্য মিথ্যে আশ্রয়কে আঁকড়াতে চায়, পাথরের মতো মেনে নেয় লাঞ্চনার জীবন৷ লম্পট, লোভী ইয়াকুবের দহন সহ্য করাটাই শ্রেয় মনে করে....সন্তানগুলোর দিকে তাকিয়ে! সবশেষে নিপূনভাবে, সবার অগোচরে জন্ম দেয় তার জঠরের শেষ সন্তাটিকে, যাকে এতোদিন লুকিয়ে রেখেছিল সবার নজর থেকে! যাকে সমাজ "জারজ" নামে গ্রহন করবে, আর দরিয়াবিবি যার জন্মের জন্য খেতাব পাবে...কলংকিনীর!!!
"দরিয়াবিবির চতুর্দিকে অন্ধকারের নৈরাজ্য৷ অন্ধকারই অন্ধকারের পরিসমাপ্তি ঘটায়৷ নচেত্‍ অভ্যস্ত জীবনে মানুষ আনন্দ পাইত কি করিয়া?"

দরিয়াবিবির কবরের গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে মোনাদির যখন বলে উঠে- "মা গো, তোমার বুকে একটু ঠাঁই দিও৷"চোখের জলগুলো ধরে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ লেখকের সার্থকতা এখানেই৷ চরিত্রগুলোর সাথে... মনের অজান্তেই একাত্বতা গড়ে দিয়েছেন৷ নাহ...উপন্যাসটির মূল যিনি তাকে নিয়ে বেশি কিছু বলব না৷ নোনতা স্বাদ নেবার আর খায়েস নেই৷ উপন্যাসটির শেষের দৃশ্যগুলো খুব লাগছে বুকে...চাপা এক ব্যাথা৷ যারা পড়েছেন...তারা খুব ভালো করেই আমার অপরাগতা বুঝতে পারবেন৷ আর যারা পড়েন নি...অনুরোধ অন্তত একবার হলেও পাতাগুলো উল্টে দেখবেন৷ দরিয়াবিবির জন্য...জননীকে জানার জন্য৷

সোমবার, ১৪ মে, ২০১২

প্রথম সাক্ষাতে...নাগিব মাহফুজ (Wedding Song...)


নাটকের রস আস্বাদন সবার পক্ষে নাকি সম্ভব নয়। হয়তবা সত্যি। তবে আমার ক্ষেত্রে ১০০% খাঁটি সত্য। নাটকের চেয়ে উপন্যাস অনেক টানে। তবে হ্যাঁ, অ্যাপ্রিসিয়েট করি মঞ্চ নাটকের অভিনেতাদের বেশি। এর কারণ দর্শাবার প্রয়োজন আদৌ আছে বলে মনে হয় না। যাই হোক্, পৃথিবীতে এমন অনেক সাহিত্যিক আছেন, যাদের সাহিত্য এক একটি মাস্টারপিস। তবে কোন কোন সাহিত্যিক অগোচরেই থেকে যায়, আবার কেউ কেউ আধুনিক উন্নত কমিউনিকেশনের বদৌলতে দৃষ্টিগোচর হয়।
তাই বলে কিন্ত নাগিব মাহফুজকে দৃষ্টির অগোচরে থাকা হিসাবে বলছিনা। ওটাতো আমার মত বাঙালী পাঠকের ব্যর্থতা। 
"নাগিব মাহফুজ" (জন্ম ১১ই ডিসেম্বর ১৯১১- মৃত্যু ৩০ আগস্ট ২০০৬ইং) একজন ইজিপ্টশিয়ান লেখক, মিশরের কায়রো শহরে জন্ম। ১৯৮৮ ইং সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী। ৭০ বছরের ক্যারিয়ারে ৫০টি নোভেল, প্রায় ৩৫০টি ছোট গল্প, ৫টি নাটক এবং ডজনখানেক মুভি স্ক্রিপ্ট তাঁর কলম থেকে এসেছে। খুব অল্পের উপর বলতে গেলে এই হচ্ছে তাঁর কর্মজীবনের ফসল। ব্যক্তিগত জীবন ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে এই লেখাতে নেই। তবে হয়তবা, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনী শেষ করা যাবে অল্প কথায়, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্মের বর্ণনা বা বিশ্লেষণ স্বল্প কথায় ব্যক্ত করবার মতন নয়। এবং অবশ্যই সেই ধৃষ্টতা দেখাতেও যাবো না।

শুরুর দিকে নাটকের কথা বলেছিলাম, কেননা গেল কিছুদিন আগে, "নাগিব মাহফুজ" এর সান্নিধ্যে আসি তাঁর রচিত "Wedding Song"- "বাসর-গীতি", কবীর চৌধুরীর অনুবাদকৃত বইটির মাধ্যমে। এই গল্পের কাহিনী মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকৌশলীদেরকে ঘিরেই আবর্তিত। এ যেন এক জবানবন্দীর দলিল। যেখানে প্রত্যেকেই নিজের সত্ত্বার কাছে জবানবন্দী দিচ্ছে। যেন নিজের প্রতিবিম্বকে বোঝাচ্ছে "প্রকৃত আমি কি....দেখ, বোঝ"! এক কথায় সাফাই গাওয়া আর কি! একদমই ইনটারনাল কনভারজেশন। নাগিব মাহফুজের সার্থকতা এখানেই। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের জবানবন্দীতে, তাদের স্বাতন্ত্রতা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা। চরিত্রগুলো যখন কথা কইছে, তখন বোঝাই যাচ্ছেনা তাদের সৃষ্টির উৎস, জঠর এক। মনে হচ্ছে যেন, নাটক মঞ্চের লোকগুলো এঁটে থাকা মুখোশ খুলছে, একজন আরেকজনের। আবার কখনো কখনো নিজেরাই নিজেদের প্রসাধনের আস্তরণ খসানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিটি চরিত্রই যার যার আপন, কদর্য বাস্তব নিয়ে কথা বলে। যেখানে আছে ধূসর হয়ে যাওয়া স্বপ্ন, না-পাওয়ার হাহাকার, বিলাপ।
 
জবানবন্দী যে চরিত্রগুলির...তারা হচেছ..তারিক রমাদান, করম ইউনিস, হালিমা আল বকস, আব্বাস।
প্রতিটি জীবনে প্রত্যেকেই এক একজন প্রধান হয়ে থাকে, এটাই ধর্ম। আর এখানেও তাই। সবাই কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু তারপরও একটা চরিত্রকে মূখ্য করবার সুক্ষ্ম একটি প্রয়াস "নাগিব মাহফুজ" এর কলমে দেখা যায়। "আব্বাস"!! মূলত এটি জবানবন্দীর দলিল হলেও একজনের প্রতি দূর্বলতা নাগিব মাহফুজ ঢাকতে পারেন নি। দোষ তাঁকে দেয়াও যায় না। কেমন করে যেন...সবার মাঝে থেকেও এই চরিত্রটি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে তার স্বকীয়তায়। তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায়। যে সমাজ, যে পরিমন্ডল থেকে এই জবানবন্দীর দলিল বেড়িয়ে এসেছে, সেখানকার পারিপার্শ্বিকতায় এ চরিত্র একদমই বেমানান। ধোঁকা, প্রবঞ্চণা, অপরাধ, নোংরামী যেখানে নৈমিত্তিক....সেখানে এই শিল্পপ্রেমিক যেন গোবরে পদ্মফুল। হয়তবা সৃষ্টির কামনায় প্রজ্জ্বলিত বলেই এই চরিত্রের উপর দূর্বলতা নাগিব মাহফুজের...যিনি নিজে বিয়ে করেছিলেন ৪২ বছর বয়সে। কারণ দর্শিয়েছেন..."তাঁর সৃষ্টিকর্মে যেন কোন বাধা তৈরি না হয়।"
"আব্বাস" এত আলাদা করে কেন নজরে লাগবে?? কারণ খুব অল্প সময়েই তার জীবন শুধুই ব্যর্থতার স্বাদ পায়...আর ছেলেবেলা থেকে তো বঞ্চনা ছিল তার সঙ্গী। ব্যর্থ স্বপ্ন, অতি কাংখিত সুখের সাওর থেকে ছিটকে পরে অসীম একাকিত্বের চোরাবালিতে ডুবতে থাকে। যেখানে হাল ছেড়ে দেবার তীব্র বাসনা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজেকে সঁপে দিতে চায় আত্মহননের হাতে।

"এই হল একাকিত্ব: একটা নীরব বাড়ি, স্মৃতি আর প্রেতাত্মায় পূর্ণ একটা হৃদয়, শুধু দু:খে বিধ্বস্ত নয়, পাপবোধ দ্বারাও, কারণ যে বরফ শীতল বাস্তবতা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তা আমার কানেও ফিস ফিস করে বলে দেয় যে, আমার কামনাগুলো এখনোও বাস্তবায়িত হয় নি। আমাকে আরোও তীব্রভাবে শোকার্ত করলেও আমার কল্পনাগুলো ভুলে যেতে চাই। তবু শোক যখন তীব্র হয়, যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে গভীরতম তল স্পর্শ করে তখন তা থেকে একটা বিচিত্র প্রমত্ততা উদ্ভাসিত হতে শুরু করে এবং তা এক ধরনের সান্ত্বনাও নিয়ে আসে..."

আত্মহননের পথে পা বাড়াবার সময়, তার শিল্পসত্ত্বা নতুন এক আলোর ঝলকানির শেষ সার্থক চেষ্টা চালায়, বেঁচে থাকবার নতুন আবরণটি দেখায়....তার ব্যর্থ সত্ত্বাকে ঢিঙিয়ে জয় হয় তার শিল্প সত্ত্বার।

"আমি এক ঘন্টা নয়, একটা যুগ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ওই যুগ থেকে আমি জেগে উঠেছি একটা নতুন যুগে। আমার ঘুমের মধ্যে একটা কিছু ঘটে গেছে, এতো মহার্ঘ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ যে এই আকস্মিক নিরাময়ের আনন্দ না দেখা দিলে, যে আনন্দ স্মৃতির মৃত্যুমুষ্টিবন্ধন শিথিল করে দিয়ে অমূল্য বস্তুনিচয়ের স্মৃতিকেন্দ্র বিস্মৃতির গর্ভে ছুড়ে দিয়েছে, আমি হয়ত এই অলৌকিক পরিবর্তনের শুরুর সামান্য একটু আভাস অন্তত স্মরণ করতে পারতাম।"


"এই পরমানন্দের অনুভূতি, একটা সৌভাগ্যবহ কবচের মতো আমি আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। তার রহস্যময়তা নিয়ে এর শক্তি অতলস্পর্শী হয়ে থাকুক। দেখ, ওই যে, এর প্রাণদায়ী শক্তি বিজয়ের সুরভি সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে!"

যারা জীবনের চলার পথে হার মেনে অপদার্থের মত পরে যেতে চায়, তাদের জন্য -

"চরম দারিদ্র্য একটা শরীরকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়েছে, তার নিজের উষরতা ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। কিন্তু একটা ইচ্ছাশক্তি আছে, আনন্দের এই চ্যালেঞ্জ তাকে মুক্তিদান করেছে, এই পরমানন্দ এখন জ্বলজ্বল করতে থাকুক তার শীর্ষবিন্দুতে।"


"নাগিব মাহফুজ" একটা অদ্ভুদ সত্য বলেছেন এখানে....

"একজন আদর্শবাদীর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আর কেউ নেই। এই পৃথিবীর যাবতীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী কে? আদর্শবাদী।"


প্রত্যেক সাহিত্যিকদের নির্দিষ্ট উপাদান, ভিন্ন ভিন্ন ইনগ্রিডিয়েন্স থাকে, যা তার সাহিত্যের স্বকীয়তা তৈরী করে। "নাগিব মাহফুজ" এর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে "সময়"। তার উপন্যাসগুলোতে কালের ভূমিকা অনেক। যেমন---

"সময় একটা ভয়ংকর সহযাত্রী", "সময় আমার বন্ধুর একী অবস্থা করেছে? তার মুখে একটা বীভৎস মুখোশ এঁটে দিয়েছে।"
 
যাক্ গে...শেষ করছি...১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সময় সুইডিশ একাডেমিকৃত নাগিব মাহফুজের সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে মন্তব্যটি দিয়ে---

".......thorough works rich in niuances--now clearsightedly realistic, now evocatively ambiguous--(Mahfooz) has found an Arabic narrative art that applies to all mankind."

রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

অবরোধ-বাসিনী......"The Women in Captivity......."


"বাঙ্গালী জাতির জাতীয় প্রেরণাই তাঁহাকে পরিচালিত করিয়াছিল৷...আশ্চর্যের বিষয় এইযে, এই প্রেরণা এমন করিয়া একজন নারীকেই আশ্রয় করিয়াছে- বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের আত্মা এবং বিবেক বুদ্ধি এমনভাবে একটি নারী প্রতিমারুপে প্রকাশ পাইয়াছে৷ একালে হিন্দু সমাজেও এমন নারী চরিত্র বিরল৷"
- মোতিললাল মজুমদার

"শুধু মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে নয়, গোটা বাংলার নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁহার স্থান অতি উচ্চে৷"
- কাজী আবদুল ওদুদ৷

"তাঁহার মত চিন্তাশীলা নারী প্রকৃতই শুধু নারী জাতি কেন, সমগ্র মানব জাতির গৌরবের পাত্রী৷"
- আবুল হুসেন৷

"অবরুদ্ধ মুসলমান অন্ত:পুরে এহেন শাণিতবুদ্ধি প্রেমপরায়ণারুপি সুন্দর প্রতিভার আবির্ভাব বিস্ময়কর ব্যাপার৷"
- আব্দুল কাদির৷

ইস্পাত....How the Steel was Tempered....


এই ভরদুপুরে লোডশেডিং এর অত্যাচারে অতিষ্ট। ঠান্ডা পানি গলায় ঢালার তীব্র ইচ্ছে অবদমিত হচ্ছে...মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটায়। ভাবছি, ইচ্ছে করলেই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি দুপুরটা। কিন্তু আজকাল মনে হয় যতটুকু সময় জীবনের আছে...সেন্স নিয়ে বাতাসগুলো শুষে নিয়ে সময়ের কাছ থেকে নিগ্রে নিতে থাকি না কেন...যখন যা পাই!!
পা ঘোরালাম লাইব্রেরীর দিকে, হাত বাড়াচ্ছি ডিটেকটিভ টাইপের একটা বইয়ের দিকে কিন্তু নজর চলে গেল..."ইস্পাত" এর দিকে। "ইস্পাত"...সাহিত্যের বাস্তব ঘরানার সবচেয়ে শিক্ষনীয়, সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচাইতে মর্মস্পর্শী একটি সাহিত্য যার স্রষ্ঠা "নিকোলাই অস্ত্রভস্কি", "Nikolai Ostrovsky" (জন্ম ১৯০৪- মৃত্যু ১৯৩৬)। আমার বাস্তব ঘরানোর সাহিত্য শিক্ষার প্রথম ধাপগুলোর মধ্যে, এই অমর সৃষ্টি একটি। বইটি হাতে নিয়ে নতুন করে পাতা উল্টাতে খুব মন চাইলো।




সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...