সোমবার, ১৪ মে, ২০১২

প্রথম সাক্ষাতে...নাগিব মাহফুজ (Wedding Song...)


নাটকের রস আস্বাদন সবার পক্ষে নাকি সম্ভব নয়। হয়তবা সত্যি। তবে আমার ক্ষেত্রে ১০০% খাঁটি সত্য। নাটকের চেয়ে উপন্যাস অনেক টানে। তবে হ্যাঁ, অ্যাপ্রিসিয়েট করি মঞ্চ নাটকের অভিনেতাদের বেশি। এর কারণ দর্শাবার প্রয়োজন আদৌ আছে বলে মনে হয় না। যাই হোক্, পৃথিবীতে এমন অনেক সাহিত্যিক আছেন, যাদের সাহিত্য এক একটি মাস্টারপিস। তবে কোন কোন সাহিত্যিক অগোচরেই থেকে যায়, আবার কেউ কেউ আধুনিক উন্নত কমিউনিকেশনের বদৌলতে দৃষ্টিগোচর হয়।
তাই বলে কিন্ত নাগিব মাহফুজকে দৃষ্টির অগোচরে থাকা হিসাবে বলছিনা। ওটাতো আমার মত বাঙালী পাঠকের ব্যর্থতা। 
"নাগিব মাহফুজ" (জন্ম ১১ই ডিসেম্বর ১৯১১- মৃত্যু ৩০ আগস্ট ২০০৬ইং) একজন ইজিপ্টশিয়ান লেখক, মিশরের কায়রো শহরে জন্ম। ১৯৮৮ ইং সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী। ৭০ বছরের ক্যারিয়ারে ৫০টি নোভেল, প্রায় ৩৫০টি ছোট গল্প, ৫টি নাটক এবং ডজনখানেক মুভি স্ক্রিপ্ট তাঁর কলম থেকে এসেছে। খুব অল্পের উপর বলতে গেলে এই হচ্ছে তাঁর কর্মজীবনের ফসল। ব্যক্তিগত জীবন ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে এই লেখাতে নেই। তবে হয়তবা, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনী শেষ করা যাবে অল্প কথায়, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্মের বর্ণনা বা বিশ্লেষণ স্বল্প কথায় ব্যক্ত করবার মতন নয়। এবং অবশ্যই সেই ধৃষ্টতা দেখাতেও যাবো না।

শুরুর দিকে নাটকের কথা বলেছিলাম, কেননা গেল কিছুদিন আগে, "নাগিব মাহফুজ" এর সান্নিধ্যে আসি তাঁর রচিত "Wedding Song"- "বাসর-গীতি", কবীর চৌধুরীর অনুবাদকৃত বইটির মাধ্যমে। এই গল্পের কাহিনী মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকৌশলীদেরকে ঘিরেই আবর্তিত। এ যেন এক জবানবন্দীর দলিল। যেখানে প্রত্যেকেই নিজের সত্ত্বার কাছে জবানবন্দী দিচ্ছে। যেন নিজের প্রতিবিম্বকে বোঝাচ্ছে "প্রকৃত আমি কি....দেখ, বোঝ"! এক কথায় সাফাই গাওয়া আর কি! একদমই ইনটারনাল কনভারজেশন। নাগিব মাহফুজের সার্থকতা এখানেই। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের জবানবন্দীতে, তাদের স্বাতন্ত্রতা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা। চরিত্রগুলো যখন কথা কইছে, তখন বোঝাই যাচ্ছেনা তাদের সৃষ্টির উৎস, জঠর এক। মনে হচ্ছে যেন, নাটক মঞ্চের লোকগুলো এঁটে থাকা মুখোশ খুলছে, একজন আরেকজনের। আবার কখনো কখনো নিজেরাই নিজেদের প্রসাধনের আস্তরণ খসানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিটি চরিত্রই যার যার আপন, কদর্য বাস্তব নিয়ে কথা বলে। যেখানে আছে ধূসর হয়ে যাওয়া স্বপ্ন, না-পাওয়ার হাহাকার, বিলাপ।
 
জবানবন্দী যে চরিত্রগুলির...তারা হচেছ..তারিক রমাদান, করম ইউনিস, হালিমা আল বকস, আব্বাস।
প্রতিটি জীবনে প্রত্যেকেই এক একজন প্রধান হয়ে থাকে, এটাই ধর্ম। আর এখানেও তাই। সবাই কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু তারপরও একটা চরিত্রকে মূখ্য করবার সুক্ষ্ম একটি প্রয়াস "নাগিব মাহফুজ" এর কলমে দেখা যায়। "আব্বাস"!! মূলত এটি জবানবন্দীর দলিল হলেও একজনের প্রতি দূর্বলতা নাগিব মাহফুজ ঢাকতে পারেন নি। দোষ তাঁকে দেয়াও যায় না। কেমন করে যেন...সবার মাঝে থেকেও এই চরিত্রটি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে তার স্বকীয়তায়। তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায়। যে সমাজ, যে পরিমন্ডল থেকে এই জবানবন্দীর দলিল বেড়িয়ে এসেছে, সেখানকার পারিপার্শ্বিকতায় এ চরিত্র একদমই বেমানান। ধোঁকা, প্রবঞ্চণা, অপরাধ, নোংরামী যেখানে নৈমিত্তিক....সেখানে এই শিল্পপ্রেমিক যেন গোবরে পদ্মফুল। হয়তবা সৃষ্টির কামনায় প্রজ্জ্বলিত বলেই এই চরিত্রের উপর দূর্বলতা নাগিব মাহফুজের...যিনি নিজে বিয়ে করেছিলেন ৪২ বছর বয়সে। কারণ দর্শিয়েছেন..."তাঁর সৃষ্টিকর্মে যেন কোন বাধা তৈরি না হয়।"
"আব্বাস" এত আলাদা করে কেন নজরে লাগবে?? কারণ খুব অল্প সময়েই তার জীবন শুধুই ব্যর্থতার স্বাদ পায়...আর ছেলেবেলা থেকে তো বঞ্চনা ছিল তার সঙ্গী। ব্যর্থ স্বপ্ন, অতি কাংখিত সুখের সাওর থেকে ছিটকে পরে অসীম একাকিত্বের চোরাবালিতে ডুবতে থাকে। যেখানে হাল ছেড়ে দেবার তীব্র বাসনা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজেকে সঁপে দিতে চায় আত্মহননের হাতে।

"এই হল একাকিত্ব: একটা নীরব বাড়ি, স্মৃতি আর প্রেতাত্মায় পূর্ণ একটা হৃদয়, শুধু দু:খে বিধ্বস্ত নয়, পাপবোধ দ্বারাও, কারণ যে বরফ শীতল বাস্তবতা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তা আমার কানেও ফিস ফিস করে বলে দেয় যে, আমার কামনাগুলো এখনোও বাস্তবায়িত হয় নি। আমাকে আরোও তীব্রভাবে শোকার্ত করলেও আমার কল্পনাগুলো ভুলে যেতে চাই। তবু শোক যখন তীব্র হয়, যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে গভীরতম তল স্পর্শ করে তখন তা থেকে একটা বিচিত্র প্রমত্ততা উদ্ভাসিত হতে শুরু করে এবং তা এক ধরনের সান্ত্বনাও নিয়ে আসে..."

আত্মহননের পথে পা বাড়াবার সময়, তার শিল্পসত্ত্বা নতুন এক আলোর ঝলকানির শেষ সার্থক চেষ্টা চালায়, বেঁচে থাকবার নতুন আবরণটি দেখায়....তার ব্যর্থ সত্ত্বাকে ঢিঙিয়ে জয় হয় তার শিল্প সত্ত্বার।

"আমি এক ঘন্টা নয়, একটা যুগ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ওই যুগ থেকে আমি জেগে উঠেছি একটা নতুন যুগে। আমার ঘুমের মধ্যে একটা কিছু ঘটে গেছে, এতো মহার্ঘ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ যে এই আকস্মিক নিরাময়ের আনন্দ না দেখা দিলে, যে আনন্দ স্মৃতির মৃত্যুমুষ্টিবন্ধন শিথিল করে দিয়ে অমূল্য বস্তুনিচয়ের স্মৃতিকেন্দ্র বিস্মৃতির গর্ভে ছুড়ে দিয়েছে, আমি হয়ত এই অলৌকিক পরিবর্তনের শুরুর সামান্য একটু আভাস অন্তত স্মরণ করতে পারতাম।"


"এই পরমানন্দের অনুভূতি, একটা সৌভাগ্যবহ কবচের মতো আমি আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। তার রহস্যময়তা নিয়ে এর শক্তি অতলস্পর্শী হয়ে থাকুক। দেখ, ওই যে, এর প্রাণদায়ী শক্তি বিজয়ের সুরভি সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে!"

যারা জীবনের চলার পথে হার মেনে অপদার্থের মত পরে যেতে চায়, তাদের জন্য -

"চরম দারিদ্র্য একটা শরীরকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়েছে, তার নিজের উষরতা ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। কিন্তু একটা ইচ্ছাশক্তি আছে, আনন্দের এই চ্যালেঞ্জ তাকে মুক্তিদান করেছে, এই পরমানন্দ এখন জ্বলজ্বল করতে থাকুক তার শীর্ষবিন্দুতে।"


"নাগিব মাহফুজ" একটা অদ্ভুদ সত্য বলেছেন এখানে....

"একজন আদর্শবাদীর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আর কেউ নেই। এই পৃথিবীর যাবতীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী কে? আদর্শবাদী।"


প্রত্যেক সাহিত্যিকদের নির্দিষ্ট উপাদান, ভিন্ন ভিন্ন ইনগ্রিডিয়েন্স থাকে, যা তার সাহিত্যের স্বকীয়তা তৈরী করে। "নাগিব মাহফুজ" এর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে "সময়"। তার উপন্যাসগুলোতে কালের ভূমিকা অনেক। যেমন---

"সময় একটা ভয়ংকর সহযাত্রী", "সময় আমার বন্ধুর একী অবস্থা করেছে? তার মুখে একটা বীভৎস মুখোশ এঁটে দিয়েছে।"
 
যাক্ গে...শেষ করছি...১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সময় সুইডিশ একাডেমিকৃত নাগিব মাহফুজের সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে মন্তব্যটি দিয়ে---

".......thorough works rich in niuances--now clearsightedly realistic, now evocatively ambiguous--(Mahfooz) has found an Arabic narrative art that applies to all mankind."

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...