রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

অবরোধ-বাসিনী......"The Women in Captivity......."


"বাঙ্গালী জাতির জাতীয় প্রেরণাই তাঁহাকে পরিচালিত করিয়াছিল৷...আশ্চর্যের বিষয় এইযে, এই প্রেরণা এমন করিয়া একজন নারীকেই আশ্রয় করিয়াছে- বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের আত্মা এবং বিবেক বুদ্ধি এমনভাবে একটি নারী প্রতিমারুপে প্রকাশ পাইয়াছে৷ একালে হিন্দু সমাজেও এমন নারী চরিত্র বিরল৷"
- মোতিললাল মজুমদার

"শুধু মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে নয়, গোটা বাংলার নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁহার স্থান অতি উচ্চে৷"
- কাজী আবদুল ওদুদ৷

"তাঁহার মত চিন্তাশীলা নারী প্রকৃতই শুধু নারী জাতি কেন, সমগ্র মানব জাতির গৌরবের পাত্রী৷"
- আবুল হুসেন৷

"অবরুদ্ধ মুসলমান অন্ত:পুরে এহেন শাণিতবুদ্ধি প্রেমপরায়ণারুপি সুন্দর প্রতিভার আবির্ভাব বিস্ময়কর ব্যাপার৷"
- আব্দুল কাদির৷

 
ইতোমধ্যে ছোট খাটো একটা আন্দাজ তো লাগানোরই কথা যে কে সেই নারী৷ ইতিহাসের পাতার উজ্জ্বলতম নক্ষত্র বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২) ৷ তিনি এমন এক নারী ব্যক্তিত্ব যিনি অমর হয়ে আছেন এবং থাকবেন মানব সভ্যতা যতদিন টিকে থাকবে৷
নিজের জীবনের খাতায় প্রমাণ করে গিয়েছেন-"আত্ম দীপ ভব, আত্ম শরণো ভব৷ অনন্যো শরণো ভব৷" এর যথার্থতা৷ নিজে প্রদীপ হয়েছেন...সেই প্রদীপের আলোয় নিজ উজ্জ্বল বিকশিত হয়েছেন৷



ধর্মের দোহাই দিয়ে গড়া অদৃশ্য কারাগার তাঁর দৃঢ় চেতনা, আত্মবিশ্বাস, প্রতিভাকে কখনোই পারেনি বন্দী করতে৷ সম্ভবও ছিলনা৷ কারণ একান্ত নিষ্ঠা ছিল তাঁর চলার পাথেয়৷ কারাগার ভেঙ্গেছেন, চেয়েছেন গুড়িয়ে দিক অন্যেরাও৷ তাই দিয়েছেন সওগাত-

"জাগো বঙ্গবাসী!
দেখ, কে দুয়ারে
অতি ধীরে ধীরে করে করাঘাত৷
ঐ শুন শুন! কেবা তোমাদের সুমধুর স্বরে বলে : সুপ্রভাত!
অলস রজনী, এবে পোহাইল,
আশার আলোকে হাসে দিননাথ৷
শিশির - সিক্ত কুসুম তুলিয়ে
ডালা ভরে নিয়ে এসেছে সওগাত৷"

ছোটবেলা থেকেই আমার প্রচন্ড দূর্বলতা সংগ্রামী সেই মানুষগুলোর প্রতি যাঁরা বাঁচতে চেয়েছিলেন শুধুই মানবতার স্বার্থে৷ নিজেকে যাঁরা কখনোই ভঙ্গুর ভাবতেন না৷ একটা সময় ছিল...আত্মবিশ্বাসের উপলদ্ধি তখনোও হয়নি কিন্ত পাঠ নেয়া যখন শুরু করলাম...তখন থেকে নিজেকে আর "Good for nothing" টাইপের ভাবতে ইচেছ করতো না৷ কমরেডদের প্রতি দূর্বলতা শুধু এই জন্যেই... তাঁরা কাজে বিশ্বাস করতেন৷ বেগম রোকেয়াকেও দেখেছি এই ব্যতিরেক ভিন্ন কোন কিছু বলে যান নি৷ তাঁর উক্তি ছিল.
."ভরসা কেবল পতিতপাবন! কিন্তু ইহাও স্মরণ রাখা উচিত্‍ যে, উর্দ্ধে হস্ত উত্তোলন না করিলে পতিতপাবনও হাত ধরিয়া তুলিবেন না৷ ঈশ্বর তাহাকেই সাহায্য করে যে, নিজেকে নিজে সাহায্য করে৷ তাই বলি, আমাদের অবস্থা আমরা চিন্তা না করিলে আর কেহ আমাদের জন্য ভাবিবে না৷ ভাবিলেও তাহাতে আমাদের ষোলআনা উপকার হইবে না৷"

ভিন্নতা কোথাও পাই নি৷ মনের অজান্তেই দিবি্ব আসন গেড়েছেন তিনি আমার হৃদয়ে...মহান এই কমরেড৷ "কমরেড" বলছি কেন!! কমরেড ব্যতীত আর কি বলুন! যে সময়...যে কালে...যে সমাজে তিনি কথা বলেছেন, লিখেছেন সেই কাল এতো সহজ ছিলনা৷ কত ভয়ংকর অন্ধকার জগত্‍ ছিল তা জানার বাকি বলে কেউ আছে... মনে হয় না৷ তাঁর একটা উক্তি বড় চমত্‍কার লেগেছিল-
"আমি কারসিয়ং ও মধুপুর বেড়াইতে গিয়া সুন্দর সুদর্শন পাথর কুড়াইয়াছি; উড়িষ্যা ও মাদ্রাজে সাগরতীরে বেড়াইতে গিয়া বিচিত্র বর্ণের বিবিধ আকারের ঝিনুক কুড়াইয়া আনিয়াছি৷ আর জীবনের ২৫ বত্‍সর ধরিয়া সমাজসেবা করিয়া কাঠমোল্লাদের অভিসম্পাত কুড়াইতেছি৷"


বোঝা যায়, কতটা (নির্বিঘ্ন!!) পথ তাঁর ছিল...পাড়ি দেবার৷
"জাগো ভাগিনী, জাগো" এই তাগিদ দেয়াতেই শুধু থেমে ছিলেন না৷ নারী শিক্ষার প্রসারের জন্য তাঁর অবদান অস্বীকার করবার ধৃষ্ঠতা, সাহস সমাজেই নেই৷ নারীশিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি নিজস্ব চিন্তাশীল রচনার মাধ্যমে জাগরণ ও মুক্তির বার্তাই তিনি এদেশের নারীদের শুনিয়েছেন৷ আর তাঁর সেই বক্তব্যগুলো, রচনাগুলোর প্রাসঙ্গিকতার ঘাটতি আজও বিন্দুমাত্র হয় নি৷
কুসংস্কারকে দেখে ভয় পান নি৷ বরং ভাবি ওমন শক্ত হাতে কলমের আঁচড় কেটেছেন কেমন করে!! মিথ্যে সমাজকে তোয়াজ তো করা দূরের কথা বরং এমন সব সত্যকে দেখিয়েছেন, যা প্রথম যখন পড়েছিলাম তখন গা শিউরে উঠেছিল৷ সৃষ্টিকর্তার প্রতি এতো কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি..যে গুনে দেখবার জো নেই৷ ওমন সময়ে আমাকে পৃথিবীতে আনবার যে পরিকল্পনা করেন নি তার জন্য, এই অধমের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই৷ আর এখন পায় হাসি!! হুম...তীব্র কষ্টের৷
"অবরোধ-বাসিনী" তে তিনি এমন কিছু ঘটনার সাথে মুখোমুখি করিয়েছেন, যা দৃশ্যত অবাস্তব বলে ঠাওড় হয়৷ আমাদের পরবর্তী জেনারেশনরা একবাক্যে বলবে "অ্যাবসার্ড!" কিন্তু নাহ৷ সে যে ছিল বড় কঠিন বাস্তব৷ অবরোধ-বাসিনী উত্‍সর্গ করেছিলেন তাঁর মাকে, যিনি অবরোধ প্রথার অন্ধ ভক্ত৷ তাঁহার মার এহেন পক্ষাপাত্তিত্বের উদাহরণ দিয়েছিলেন এক ঘটনা দিয়ে৷ নদীতে স্টিমার যোগে পার হবেন, গ্রীস্মকাল৷ স্টিমারের ডেকের উপর বানাতের ওয়ার ঘেরা রুদ্ধ পাল্কির ভেতর বন্দী অবস্থায় আছেন তিনি, তাঁর ২ বত্‍সরের ছোট বোন এবং উনার মা৷ এমন ভয়ংকর গরমে স্বাভাবিক কোন ছোট্ট শিশুর আত্মা এনজয় করবেনা৷ কান্না জুড়ে দেয়৷ কিন্তু ওই অবস্থায় না তাঁর মা তাকে বের করেন, আর না কেউ তাকে উদ্ধার করেন!!
যাই হোক্, নতুন করে বেগম রোকেয়া আবার হাতে নিয়েছি৷ সবার আগে চোখ গেল এই অবরোধ-বাসিনীর উপর৷ "অবরোধ-বাসিনী" থেকে দু-একটা ছোট্ট ঘটনা শেয়ার করছি৷ যার মধ্যে একটা হুবহুই তুলে দিলাম৷

"এক বাড়িতে আগুন লাগিয়াছিল৷ গৃহিনী বুদ্ধি করিয়া তাড়াতাড়ি সমস্ত অলঙ্কার একটা হাত বাক্স পুরিয়া লইয়া ঘরের বাহির হইলেন৷ দ্বারে আসিয়া দেখিলেন সমাগত পুরুষেরা আগুন নিবাইতেছে৷ তিনি তাহাদের সম্মুখে বাহির না হইয়া অলঙ্কারের বাঙ্টি হাতে করিয়া ঘরের ভেতর খাটের নীচে গিয়া বসিলেন৷ তদবস্থায় পুড়িয়া মরিলেন, কিন্তু পুরুষের সম্মুখে বাহির হইলেন না৷ ধন্য! কুল-কামিনীর অবরোধ!"

আরেক ঘটনা ছিল জমিদারের ঘরে বিয়ের আয়োজন৷ সবাই ঘুমে৷ এমনতর অবস্থায় চোর মহাশয়ের আগমন৷ বাড়ির মর্দরা ঘরের চারপাশে কুড়াল হাতে অপেক্ষা করছে৷ আর ভেতরে চোর নির্বিঘ্নে হাত সাফাই করে যাচেছন৷ ঘরের ভেতর যে কেউ নেই তা কিন্তু নয়৷ তাতে গোটা কয়েক বিবিরা মজুদ৷ তাহারা টুঁ আওয়াজ করছেনা৷ বেগানা পুরুষ গলার স্বর শুনবে বলে৷ হাত পায়ের গহনা খুলে সামনে রেখে দিচেছ৷ নতুন যে বউ তার পক্ষে কানের ঝুমকাগুলো খোলা সম্ভব হচ্ছিল না, পেঁচিয়ে গিয়েছিল বলে৷ চোর কিছুক্ষণ ভদ্রতাবশত অপেক্ষা করে, পরে ছুরি দিয়ে দু'কান কেটে ঝুমকাগুলো নিয়ে আরামসে পলায়ন!!! বলুন হাসি পায় না কেমনটা লাগে!!
বিহার অঞ্চলে বিয়ের ৩ মাস পূর্বে মেয়েদের "মাইয়া-খানায়" বন্দী করে রাখা হতো৷ যদি কোন কারণবশত বিয়ের দিনক্ষণ পিছিয়ে যেত তাহলেও মেয়েদের ওভাবে ওখানে বন্দী থাকতে হতো৷ কখনো কখনো তা ১ বত্‍সরও হয়ে যেত৷ তো এমন এক মেয়ে বন্দী হিসাবে আছে৷ কারোর দিকে তাকানো যাবে না৷ মাথা গুঁজে ওখানেই বসে থাকতে হবে, রাতে ওখানেই ঘুম৷ তাকে কোলে করে স্নানগারে নিয়ে যাওয়া হয়, খাইয়ে দেয় এমনকি পানিটাও অন্য একজন খাইয়ে দেয়৷ মোটকথা "নড়নচড়ন" যাকে বলে...সম্ভব নয়৷ যাই হোক, ছয় মাস পর যখন মেয়েটির বিবাহের দিন উপস্থিত, দেখা গেল সে চোখে দেখতে পায় না৷ কারণ!! একনাগাড়ে ছয় মাস চোখ না মেলবার উপহার!

যাক্, আর বাড়াতে যাবো না৷ যারা অবরোধ-বাসিনী পড়েছেন তারা তো জানেনই৷ আর যারা পড়েন নি, অনুরোধ রইল... ঘেঁটে দেখবেন৷ আমি তো লিখে গেলাম খুব সহজে ম্যাটেরিয়ালিস্টিক স্টাইলে কি-বোর্ডে ঝড় তুলে, আর যারা পড়লেন, কষ্ট করে মনিটরের পর্দায় চোখ রেখে৷ দুটো কাজই খুব সহজ৷ কিন্তু যাদের নিয়ে পড়ছি, লিখছি... এতোই কি সহজ ছিল সব তাদের জন্য!!!


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...