শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (4th Part)

~সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~

লেখক: মনোয়ার শামসি সাখাওয়াত 

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।


৫. উদ্ধৃতি সহযোগে যুক্তি ও প্রতিযুক্তির বিস্তারণ
এই তুলনামূলক পাঠের প্রথম তিনটি পর্বে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে মওদূদী এবং নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা ও জাহিলিয়া প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তকের বয়ানের মূলসূত্র ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।


তিনটি পর্বে আলোচ্য বিষয়বস্তু সংক্ষেপে সারমর্ম বা সারাংশ আকারে পরিবেশিত হবার কারণে সেখানে দুজন চিন্তকের প্রাসঙ্গিক রচনা থেকে কোন উদ্ধৃতি দেয়া হয়নি।


যেহেতু মূলসূত্রগুলো পড়বার ফলে এখন তাদের চিন্তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পাঠকদের একটি প্রাথমিক ধারণা ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে বলে মনে করছি, তাই এবারের পর্বে মওদূদীর চিন্তাকে তার নিজস্ব রচনা থেকে প্রথমে উদ্ধৃত করে উপস্থাপন করব এবং এরপরে নাদভীর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করব যে তিনি কিভাবে মওদূদীকে খন্ডন করতে চেয়েছেন। কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণাতেই আমরা আপাতত মনোযোগ দেব।


সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীঃ


মওদূদীর রচনা থেকে প্রথম যে উদ্ধৃতিটি দেব সেটি হল তার ‘কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা’ নামক বই থেকে। এখানে তিনি তার থিসিস বা চিন্তাকল্পের প্রেমিস বা মূলসূত্রটি পেশ করেছেনঃ


“ইলাহ, রব, দীন ও ইবাদাত – কোরআনের পরিভাষায় এ চারটি শব্দ মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী। কোরআনের সার্বিক দাওয়াত এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই একক রব ও ইলাহ; তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, নেই কোন রব। উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাত-এ কেউ তাঁর শরীক নেই। সুতরাং তাঁকেই তোমাদের ইলাহ ও রব মেনে নাও; তিনি ব্যতীত অন্য সকলের উলুহিয়্যাত-রুবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করো। তাঁর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া অপর কারো ইবাদাত করো না। দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যেই খালেস করো, অন্য সব দীনকে প্রত্যাখ্যান করো।” [১]


এরপরে তিনি তার মূলসুত্রকে বিস্তার করেছেন এভাবেঃ


“এটা স্পষ্ট যে, কোরআনের শিক্ষা অনুধাবন করার জন্যে পরিভাষা চতুষ্টয়ের সঠিক ও পরিপূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করা একান্ত অপরিহার্য। ইলাহ শব্দের অর্থ কি, ইবাদাতের সংজ্ঞা কি, দীন কাকে বলে – কোন ব্যক্তি যদি তা না জানে তবে তার কাছে সম্পূর্ণ কোরআনই অর্থহীন হয়ে পড়বে। সে তাওহিদ জানতে পারবে না, শের্ক বুঝতে পারবে না, ইবাদাতকে একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে নিবেদিত করতে পারবে না, দীনকে করতে পারবে না আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট। অনুরূপভাবে কারো মানসপটে যদি এ পরিভাষাগুলোর তাৎপর্য অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ থাকে, তবে তার কাছে কোরআনের গোটা শিক্ষাই অস্পষ্ট থাকবে। কোরআনের প্রতি ঈমান রাখা সত্ত্বেও তার আকীদা ও আমল – বিশ্বাস ও কর্ম – উভয়ই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।” [২]


এর কারণ ও ফল খুঁজতে গিয়ে মওদূদী লিখেছেনঃ


“আরবে যখন কোরআন পেশ করা হয়, তখন প্রত্যেকেই জানতো ইলাহ অর্থ কি, রব কাকে বলা হয়। কারণ তাদের কথাবার্তায় এ শব্দদ্বয় পূর্ব হতে প্রচলিত ছিল। তারা জানতো এ শব্দগুলোর অর্থ কি, কি এর তাৎপর্য। তাই তাদের যখন বলা হলো যে, আল্লাহ-ই একক রব ও ইলাহ, উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতে আদৌ কারো হিস্যা নেই, তারা তখন ঠিক ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। ... ... অনুরূপভাবে ইবাদাত ও দীন শব্দও তাদের ভাষায় প্রচলিত ছিলো পূর্ব হতে। তারা জানতো, আব্দ কাকে বলে, উবুদিয়্যাত কোন অবস্থার নাম। ইবাদাতের উদ্দেশ্য কোন ধরণের আচরণ, দীনের তাৎপর্য কি? তাই তাদের যখন বলা হলো, সকলের ইবাদাত ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদাত করো, সকল দীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর দীনে দাখিল হও, তখন কোরআনের দাওয়াত বুঝতে তাদের ভুল হয় নি। এ শিক্ষা আমাদের জীবন ব্যবস্থায় কোন ধরণের পরিবর্তন চায়, শোনামাত্রই তারা তা বুঝতে পেরেছিলো।"


"কিন্তু কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচলিত ছিল, পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এক একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকতা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে। এর এক কারণ ছিল আরবী ভাষার প্রতি সঠিক স্পৃহার অভাব, দ্বিতীয় কারণ ছিল ইসলামী সমাজে যেসব ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে, তাদের কাছে ইলাহ, রব, দীন, ইবাদাতের সে অর্থ অবশিষ্ট ছিলো না, যা কোরআন নাযিল হওয়ার সময় অমুসলিম সমাজে প্রচলিত ছিলো। এ কারণে পরবর্তী কালের অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থে অধিকাংশ কোরানিক শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে আভিধানিক অর্থের পরিবর্তে এমন সব অর্থে যা পরবর্তী কালের মুসলমানরা বুঝতো। ... ... ...”


“ফল দাঁড়ালো এই যে, কোরআনের মৌল উদ্দেশ্য অনুধাবন করাই লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো। ... ... ...”


“এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কোরআনের তিন-চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। ইসলাম কবুল করা সত্ত্বেও মানুষের আকিদা-আমল-বিশ্বাস ও কর্মে যে সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এটা তার অন্যতম প্রধান কারণ। সুতরাং কোরআনুল করীমের মৌল শিক্ষা এবং তার সত্যিকার লক্ষ্য স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্যে এর পরিভাষাগুলোর সঠিক ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা একান্ত জরুরী।” [৩]




সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভীঃ

এবারে নাদভীর রচনা থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে আমরা দেখব যে তিনি কিভাবে মওদূদীর উপরোক্ত বয়ানকে খন্ডন করতে চেয়েছেন।


নাদভী কোরআন সম্পর্কে যে প্রচলিত ধারণাটিকে বারবার মওদূদীর উপরোক্ত বয়ানের খন্ডন হিশেবে ব্যবহার করেছেন সেটি হল প্রচলিত এই ধারণাটি -- যে কোরআন নাযিল হয়েছে সহজ আরবীতে এবং সহজ ভাষায় যাতে করে সাধারণ মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে। এটিকে তার খন্ডন প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের লক্ষে তিনি কোরআনের একটি প্রাসঙ্গিক আয়াত উদ্ধৃত করে সূচনা করেন তার ‘এপ্রিসিয়েশন এন্ড ইন্টারপ্রিটেশন অফ রিলিজিয়ন ইন মডার্ন এজ’ গ্রন্থটি। এই সমর্থনবাচক পুরো উদ্ধৃতিটি তিনি এই গ্রন্থে প্রয়োগ করেন তার আগেই লেখা ‘সেভিয়ার্স অফ ইসলামিক স্পিরিট’ গ্রন্থ থেকেঃ


“The scripture has clearly laid the tenets of belief and code of conduct, if only because these are meant to be understood and acted upon by every human being:


‘And We never sent a messenger save with the language of his folk, that he might make (the message) clear for them.’

(Ibrahim: 4)


“The meaning of this verse is manifestly clear. The Prophet of Islam too had explained the import of divine revelations and lived up to those precepts so that his followers might not remain in any doubt. The vocabulary of the Quran and its meanings have thus been handed down, from the Prophet, without any break, and have ever afterwards been recognised and accepted by everyone as authentic and genuine, and to which no one raised any objection.” [৪]
নাদভী তার এই প্রতিযুক্তি উত্থাপন করার আগে কুর’আনের চার পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন হয়েছে এবং অস্পষ্ট হয়ে গেছে বলে মওদূদীর দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে এর ফলে মনে হয় যেন সমগ্র উম্মাহ বা এর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে কুর’আনের সত্য এতদিন অজানা ছিল; এবং দীর্ঘদিন ধরে কুর’আনের পরিভাষা সম্পর্কে উম্মাহ সামগ্রিকভাবে অজ্ঞ ছিলঃ


“On reading these passages one who has not made deep and extensive study and who is not aware of the fact that God has preserved this Ummat from going astray generally, can infer that the reality of the Quran remained hidden from the Ummat or the majority of it, for a long time and the Ummat remained collectively ignorant of the reality of the basic terms round which revolves the whole structure of the Book and on which rests the edifice of its teachings and exhortations and the veil could be lifted only by the middle of twentieth century.” [৫]

তিনি লেখেন যে এর ফলে উম্মাহর কুর’আন বোঝার ক্ষমতার উপর অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছেঃ


“On a cursory look his conclusion may not appear very damaging and serious but its impact on mind and the way of thinking would be far-reaching for it raises doubts in the capabilities of the Ummat which is not only the bearer of the religion and the message but is responsible for its expansion over the world and its elucidation and protection. It also casts doubts on the history of the Ummat and belittles the achievements of its renovators, reformers and religious doctors in scientific and scholarly fields and in their practices. For future also it will raise doubts about the authenticity of what is being said or understood today.” [৬]

মওদূদীর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নাদভী মধ্যযুগের ‘বাতিনী’দের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তুলনা করে লেখেনঃ


“It will also give strength to the philosophy of ‘the apparent and the hidden’ and the ‘kernel and the shell’ and make religious truths incomprehensible and abstruse riddles which was the way of the different groups of Batinites in different times.” [৭]


রেফারেন্সঃ

[১] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা, অনুবাদঃ গোলাম সোবহান সিদ্দিকী, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, জুন ২০০২, পৃ. ৯

[২] প্রাগুক্ত, পৃ. ১১

[৩] প্রাগুক্ত, পৃ. ১১ – ১৩

[৪] S. Abul Hasan Ali Nadwi, Appreciation and Interpretation of Religion in the Modern Age, Translated by Syed Athar Husain, Academy of Islamic Research and Publications, Lucknow, 1982, Page 33

[৫] Ibid, Page 32

[৬] Ibid, Page 32

[৭] Ibid, Page 32



(চলবে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...