সোমবার, ৩০ জুলাই, ২০১২

যাযাবরের...."দৃষ্টিপাত"!!

প্রথমেই বলব, "যাযাবর" এর "দৃষ্টিপাত" সার্থক নামকরণ৷ কেননা, যাযাবর হিসাবে.. দেশ, রাষ্ট্র, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা, রীতি-নীতি, মানুষ, মানুষের জীবনদর্শন একেবারেই নিজের ভঙ্গিতে উঠে এসেছে.."দৃষ্টিপাত" এ৷ অকপটে বলে যাওয়া কাহিনী যেখানে ইতিহাসকেও খুঁড়ে দেখা হয়েছে...আবার বাস্তব জীবনের ঘরগুলোর ভেতরকার ছবিও উঠে এসেছে৷ যদিও "দৃষ্টিপাত" কোন গল্প কিংবা উপন্যাস নয়৷ এ একেবারেই অচেনা লোকদের পত্র পড়া, যদিও লুকিয়ে নয়৷ সংকলিয়তা, ভূমিকা আকারে নিবেদন করেছেন যে.....পুরোটাই উঠিয়ে দিচ্ছি...


"এই রচনাটির একটু ভূমিকা আবশ্যক৷ ১৯৩৬ সালে একটি বাঙ্গালী যুবক লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়িতে যায়৷ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে গাওয়ার স্ট্রিটের ভারতীয় আবাসটি জার্মান বোমার আঘাতে বিধ্বস্ত হইলে আত্মীয়বর্গের নির্বন্ধাতিশয্যে যুবকটি ভারতবর্ষে ফিরিয়া আসে৷ স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপসের আলোচনার প্রাক্কালে বিলাতের একটি প্রাদেশিক পত্রিকা তাহাকে তাহাদের নিজস্ব সংবাদদাতা নিযুক্ত করিয়া দিল্লীতে পাঠান৷ লন্ডনে অবস্থানকালে এই পত্রিকায় সে মাঝে মাঝে প্রবন্ধ লিখিত৷

দিল্লীতে যাইয়া যুবকটি তাহার এক বান্ধবীকে কতগুলো পত্র লেখে৷ বর্তমান রচনাটি সেই পত্রগুলি হইতে সংকলিত.............

এই স্বল্পপরিসর পত্ররচনার মধ্যে লেখকের যে সাহিত্যিক প্রতিভার আভাস আছে, হয়তো উত্তরকালে বিস্তৃত সাহিত্য চর্চার মধ্যে একদা তাহা যথার্থ পরিণতি লাভ করিতে পারিত৷ গভীর পরিতাপের বিষয়, কিছুকাল পূর্বে এক আকস্মিক দূর্ঘটনায় তার অকালমৃতু্য সেই সম্ভাবনার উপরে নিশ্চিত যবনিকা টানিয়া দিয়াছে৷"
যদি এই রচনাটি কেউ পড়ে থাকেন তবে একমত পোষণ করতে বাধ্য, আর যদি কেউ না পরে থাকেন... তবে অনুরোধ রইল একবার হলে ঘেঁটে দেখার৷


লেখক তার দৃষ্টিভঙ্গিতে যেমন দেখেছেন, বুঝেছেন....অকপটে লিখেছেন...এই যেমন

"সংস্কারের মুক্তি তো যুক্তি দিয়ে হয় না, যেমন বুদ্ধি দিয়ে জয় হয় না ভূতের ভয়৷ সংস্কার রাতারাতি পরিহার করতে হলে চাই বিপ্লব, রয়ে-সয়ে করতে হলে চাই অভ্যাস৷ "
"মানুষের বহু বিচিত্র, তার পরিচয়ের নাই শেষ৷ তার সত্তা ধ্রুব নয়, পরিবেশের পরিবর্তনে তার প্রকাশ হবে বিভিন্ন৷"

ভারতের ইতিহাসে ধর্মের অনুসারীরা তার দৃষ্টিতে কিছুটা এইরকম...

"হিন্দুরা তপস্বী, তারা দিয়েছে বেদ ও উপনিষদ৷ মুসলমানেরা শিল্পী, তারা দিয়েছে তাজ ও রঙমহল৷ হিন্দুরা সাধক, তারা দিয়েছে দর্শন৷ মুসলমানেরা গুণী, তারা দিয়েছে সঙ্গীত৷ হিন্দুরা গর্ব মেধার, মুসলমানেরা গৌরব হৃদয়ের৷"

নিজে জার্নালিস্ট ছিলেন বলেই কিনা...

"জেন্টলম্যানরা যদি জার্নালিস্ট হতে পারেন, জার্নালিস্টরা জেন্টলম্যান হতে পারবেন না কেন?"

"মানুষের জীবন যখন জটিল হয় নি, তখন তার অভাব ছিল সামান্য, প্রয়োজন ছিল পরিমিত৷"
খুব সহজে বলে যাওয়া চরম এক বাস্তব৷

"প্রেম ভালো, বিদ্বেষ দুঃখের কিন্তু সবচেয়ে মারাত্মক ইন্ডিফারেন্স- যে কাছেও টানে না- দূরেও ঠেলে না- শুধু ভুলে থাকে৷"
যাযাবর তো কাজেই মাদ্রাজি, পাঞ্জাবী, বাঙ্গালি ঘেঁটেছেন....এক চমত্‍কার কথাও বলেছেন....

"ইংরেজি শিক্ষা ও সভ্যতাকে প্রথম বরণ করল বাঙ্গালি৷ সে যুগের বাঙ্গালির প্রাণশক্তি ছিল প্রচুর, প্রতিভা ছিল প্রখর৷ ইংরেজের সাহিত্য, বিজ্ঞান ও সভ্যতাকে সে গলাধঃকরণ করল না, করল গ্রহণ৷ আপন ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির জারক রসে পরিপাক করে তাকে সে আত্মসাত্‍ করল৷ পশ্চিমের চিন্তাধারাকে সে ধার করল না ধারণ করল৷ তাই বাঙ্গালীর মধ্যে সম্ভব হল মাইকেল মধূসূদন, বিবেকনন্দ ও চিত্তরঞ্জন দাশ৷"

তোফা তোফা....বেশ কিছু মানুষের জীবনের দর্শনও উঠে এসেছে তার দৃষ্টিপাতে৷ বেশ কিছু মানুষের অব্যক্ত সব কথা....এই আধারকারেরই যেমন....এবং তার সাথে বলে রাখি যদি কেহ মদিরা প্রেমী হয়ে থাকেন অথবা কৌতুহলী তবে তার জীবনদর্শনে দেখা এই আজব লোকের দর্শন পেয়ে যাবেন যার নাম রচনায় উল্লেখিত চারুদত্ত আধারকার৷ বিভিন্ন ককটেল মেকিং এর উদ্ভাবিত তার সর্ট রেসিপি৷
যেহেতু ছিলেন এক জার্নালিস্ট ঘাঁটতে হয়েছে রাজনীতি, নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরেছেন তখনকার বৃটিশ এবং ভারতীয়দের চিত্র৷ এক মজার কথা বলেছেন....ভারতীয় বিভাগে বাঙ্গালিরা অবাঞ্চিত বেশি, কেননা আর্মির "মনুসংহিতায়" বাঙ্গালিরা নাকি "হরিজন"!! এর কারণ দর্শিয়েছেন...বিংশ শতাব্দীর প্রথামাংশ থেকে এই বাঙ্গালিরাই প্রথম তেজে এবং অবিরতভাবে ইংরেজ শাসনের বিরোধিতা করে এসেছে, স্বাধীনতার স্বপ্ন তারাই দেখেছে প্রথম৷ সিপাহী বিদ্রোহের প্রথম লক্ষণও প্রকাশ পেয়েছিল বাংলাদেশের এক ছাউনিতে৷ ব্যারাকপুরে৷ সত্য।
আলোচিত সেই "ক্রিপস" আলোচনাও উঠে এসেছে তার এই রচনাটিতে৷ ব্যক্তি ক্রিপস এবং রাষ্ট্রীয় চামচা ক্রিপসকে তুলনামূলকভাবে তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করেছেন৷ ক্রিপস বলেছিলেন যে...
"ভারতবর্ষের বিভিন্ন দলের মধ্যে যে প্রবল মতবিরোধ বর্তমান, একজন নিরপেক্ষ মধ্যস্থ ব্যক্তির ভূমিকা নিয়ে ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট তার একটি সমাধান করতে চেয়েছিলেন৷"

এবং লেখকের ভাষ্যমতে, শ্রোতারা বিস্ময়ে চক্ষু মার্জন করে ভাবল, এডলফ হিটলারের বক্তৃতা শুনছি না তো! তিনিও তো বলেন, তিনি চিরকাল শান্তি চেয়েছিলেন!
যাক গে, কারো কি জানা আছে..."দিল্লী দূল অস্ত" এই বিখ্যাত লাইনের কাহিনী! অতি সংক্ষেপে তবে নিখুতভাবে লেখকের কাছ থেকে জানতে পেরেছি.....এটা না পড়ে দেখে নেবেন।
"যাযাবর" ঘুরে দেখেছেন ঐতিহ্যশালী ভারতকে৷ সব উঠে না আসলেও তার দর্শনে যেমন পৃথীরাজ ছিল ঠিক তেমন ছিল আউলিয়া, মোঘল, তুঘলক, বাদশা বাহাদুর শাহ ও সাজাহান৷ সাজাহানের আদরের দুহিতা জাহানারা৷ জাহানারা ছিলেন ফকির নিজামুদ্দিন আউলিয়ার একজন বড় ভক্ত এবং তার সমাধি যেন তাঁর পাশেই হয়, এই ছিল তার ইচ্ছা৷ হয়েছেও তাই...উনি তার সমাধি বাহুল্যবর্জিত চেয়েছিলেন...তাই রমজানের কোন পুণ্য তিথিকে তিনি যখন শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তার সমাধি নিজামুদ্দিন আউলিয়ার সমাধির পাশেই করা হয়৷ এবং সম্পূর্ণ বাহুল্যহীন যেখানে উনার নিজেরই লেখা কবিতা স্থান পেয়েছে....

"বেগায়র সবজা না পোশাক কসে মাজারে মারা,
কে কবর পোষে গড়িবান হামিন্ গিয়াহ বসন্ত৷"



-একমাত্র ঘাস ছাড়া আর কোন কিছু যেন না থাকে আমার সমাধির উপরে৷ আমার মত দীন দরিদ্র অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন৷




**সব মিলিয়ে সঙ্গত কারণেই আমি বলব বইপ্রেমীদের কালেকশনের প্রথম পর্যায়ে অবস্থান করবার যোগ্যতা যথার্থই "দৃষ্টিপাত" এর আছে। আর কে এই "যাযাবর"!!
"বিনয় মুখোপাধ্যায়" যাঁর আরোও এক ছদ্মনাম রয়েছে..."শ্রী পথচারী"।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...