শনিবার, ১৪ জুলাই, ২০১২

হাজারি ঠাকুরেরই....."আদর্শ হিন্দু হোটেল"


নাহ....কখনো কখনো ভাবি যদি ফিরে যেতে পারতাম অতীতের দিনগুলিতে!! পেরিয়ে আসা সময়গুলোর মাঝের কোন একটা দশকে যদি জন্ম নিতাম!! "সততা" এখন শুধুই অতীতেরই ফ্রেম।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে তো আর নতুন করে চেনাবার কিছু নেই, বাংলা সাহিত্যের উঁচু পর্যায়ের লেখক, (সেপ্টেম্বর ১২, ১৮৯৪ ইং - নভেম্বর ১, ১৯৫০ ইং সাল) "আদর্শ হিন্দু হোটেল" তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলোর মধ্যে একটি। সম্ভবত "আরণ্যক" প্রকাশের পর, ১৯৪০ইং সালে এটি প্রকাশিত হয়। সততার কথা টেনে আনা...কারণ যে সময়কার চিত্রপটে লেখা তাঁর এই উপন্যাস সেখানে সততা যে কত বড় শক্তি তা প্রতি মুহুর্তে টের পাচ্ছিলাম, পাতাগুলো উল্টাবার সময়। দেখছিলাম...মানুষগুলো কত সৎ!! হিংসার জলন্ত আগুন যদিও দেখেছি কিন্তু তবুও শেষ অব্দি সততার বলয়ে তার নতুজানু হবার "সত্য"টাকেও দেখেছি।

প্রতিটি চরিত্রই তাদের ভিন্ন ভিন্ন সত্তা নিয়ে আলোকিত যদিও কাহিনীর নায়ক একজনই....আমাদের বুড়ো নায়ক। প্রেমে পড়ার মতন নয়...ভালোবাসার মতন, শ্রদ্ধা করার মতন একজন অতি সাধারণ হাজারি চক্রবর্তী, রসুয়ে বামুন ঠাকুর। যার হাতের রান্নার সুখ্যাতি সবার মুখে মুখে, এ যেন ঈশ্বরের আর্শিবাদ, আমার তো মনে হয় ভগবান এতটাই তৃপ্ত যে হাজারি ঠাকুর স্বর্গে গেলে বলবে..."ঠাকুর, একটু রেঁধে খাওয়াতো দেখি!" যাক গে, বই পড়বার এই মুসকিল! প্রকৃতির স্বাদ চোখ বুজে যাও অনুভব করা যায়...যদি কোন রান্নার অতুলনীয় বর্ণনার কাহিনী পড়া হয়, তবে তা পেটে আগুন লাগানো ছাড়া মনে হয়না আর কোন অনুভূতি জাগাতে পারে..(ক্ষণে ক্ষণে সুরঞ্জনাদি এবং উদারজী ভাইয়ের উদার রান্নাঘরের ছবি মনে ভাসল, যদিও তাদের হাতের রান্নার স্বাদ নেয়া হয়নি) যাহ, কি লিখতে গিয়ে কি লিখছি...লোভী রুপ বের করে ফেলছি..
আক্ষরিক অর্থে আমার সবচাইতে ভালো লেগেছে...ফাটাফাটি বলে যাকে "পদ্মা ঝি" কে। জীবনের উন্নতিতে এদের মত চরিত্রের অবদানটাই কিন্তু বেশি, যদি এদের মুখ নিসৃত: বাণী ভালো করে কেও গায়ে লাগায় তো! প্রথমেই মুখ নিসৃত: বাণীর একটিতে খুব মজা পেয়েছিলাম...

"পোড়ারমুখো মিনসে আবার শুনতে না পায়। কি যে ওর রান্নার সুখ্যাত করে লোকে, তা বলতে পারি নে- কি এমন মরণ রান্নার!"
বোঝাই যাচ্ছে...উপনাস্যের ভিলেনের চরিত্র ৮০% এই পালন করছে!

রাণাঘাটের রেলবাজারে বেচু চক্রবর্তীর খাবারের হোটেলের সেরা রাধুনী হাজারি ঠাকুর, যদিও নুন্যতম সম্মান তার মালিক তাকে কখনোও দেন নি বরং ঝেড়েছেন কখনো কখনো পদ্ম ঝির উস্কানিতে। তবে তা পুষে গিয়েছে যখন খদ্দেররা বলেছেন...
"সেই বামুন ঠাকুরকে দিয়ে রান্না করানো চাই। নইলে আমরা অন্য জায়গায় যাব।"

পরিপূর্ণ আত্মতৃপ্তি একজন রাধুনীর এই কথাতেই হয়ে যায়। কিংবা যখন মালিকের ব্যবসায়ীক প্রতিদন্দ্বী তাকে বেশি বেতনের চাকুরী দেবার প্রস্তাব দেয়!

প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হাজারি ঠাকুর ও সাথের কিছু চরিত্রের সরলতায় তৈরি একটা আত্মবিশ্বাসের শক্তি, কখন যেন আমি নিজেও অনুভব করলাম। বিশ্বাস দৃঢ় হলো, একজন মানুষ নিজের কাজের প্রতি যদি নিজে বিশ্বাস রাখে, সততার আবরণে বিশ্বাস রেখে যদি পথে নামে...গন্তব্য নিজেই কাছে চলে আসে। যদিও আজকালের বাস্তবতার খাতিরে সঙ্গায় একটু যোগ করতে হবে যে, সততার চাদরটিতে বুনতে হবে....একটু টেকনিকের ডিজাইন..(টেকনলজির যুগ যে!!)
দাগ কাটা চরিত্রগুলি...রতন ঠাকুর, বংশী, কুসুম, পাড়াগায়ের কায়স্ত ঘরের এক অল্প বয়সী বধু (যার সরলতা অদ্ভুদ)।
আর ব্যক্তিগতভাবে প্রেমে পরেছি অতসীর। বিভূতিবাবু যে তার সৌন্দর্যের বর্ণনা দিয়েছেন সে থেকে নয়...প্রেমে পড়েছি...তার অমায়িকতায়, বাহুল্যহীনতায়। কেমন যেন এক স্নিগ্ধতার আবেশ তার কথায়, উপস্থিতিতে...যদিও শেষে তার পরিনতি কষ্ট দিয়েছে, প্রশ্ন করেছিলাম কি দরকার ছিল তার অমন পরিনতির!!
আরোও একজন আছে, হরিচরণ বাবু, অতসীর বাবা। তার এক উক্তি...খুব বেজেছিল বুকে...

"উদ্যমই জীবনের সবটুকু। যার জীবনে আশা নেই, যা কিছু করার ছিল সব হয়ে গেছে- তার জীবন বড় কষ্টকর।"

নদীর ধারে ফাঁকা এক জায়গা হাজারি ঠাকুরের চিন্তার, আমার কাছে ধ্যান করার মতই স্থান। কেননা, এই জায়গাতেই সে স্বপ্ন দেখেছে...স্বপ্ন বুনেছে হাজার। স্বপ্ন দেখেছে তার নিজের হোটেলের..."হাজারি চক্রবর্তীর আদর্শ হিন্দু হোটেল"। যেখানে খদ্দেরের সাথে কোন প্রতারণা হবে না। পয়সা দিয়ে তারা খাবে, তৃপ্তি করে খাবে। খাওয়ার পর যেন বলতে পারে...পয়সা উসুল হলো। কারণ সে বুঝেছিল...
"পরের তাঁবে কাজ করিলে মানুষকে দয়া মায়া বিসর্জন দিতে হয়।"

বইয়ের প্রতিটি পাতায় পাতায় খুব গভীর জীবনবোধের তেমন কোনকিছু না থাকলেও....স্বপ্নের মত জীবনের এক একটি ধাপ ছিল, কিন্তু অবশ্যই সাধারণের বাস্তবজীবনের আঙিকেই।
হুমম...বইয়ের শেষ পাতা উল্টে আবিস্কার....আমি আপন মনে কখন যেন হেসেছিলাম! হতে পারে...পদ্ম ঝিয়ের কর্মে....

"ঠাকুর মশাই, পায়ের ধুলোটা দেন একটু।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...