মঙ্গলবার, ২২ মে, ২০১২

জননী.....A novel of Motherhood.....


অভাব অনটনের, না পাবার কালো ছায়ায় অভিশাপ থেকে, হাজারো দূরে বসে মর্ডানাইজড সভ্যতার সুফলগুলো নিয়ে বাস করা যেমন বাস্তব, ঠিক তেমনি উত্তপ্ত রবির পরশে শরীরের নোনতা তরল নিঃসরন, হাঁড়কাপা শীতকে পাতলা চাদরে বাগে আনা, কখনো বা একবেলা, একমুঠোয় পেট পূজা, কখনো বা তাও না....এটাও বাস্তব৷ বাস্তব রুঢ়ও যেমন, প্রহসনও তেমন৷ বাস্তব শুধুই নিষ্ঠুর...এমনটা ভাবা সেঁকেলে টাইপ একপেশে মন্তব্য৷ বাস্তব....তোমার আমার মিষ্টি কথোপকথন...চায়ের কাপে টোকা মেরে তুমুল আড্ডা বন্ধুদের সাথে, দূরে কোথাও প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়া৷ বাস্তবতো এটাও..তাই না!!

এতো বাজে বকছি...কারণ, "নাই কাজে খই ভেজেছি" এখন সার্ভ না করা পর্যন্ত মনশান্তি যাকে বলে ঠিক পাচ্ছিনা৷ ভালোই ছিলাম...কিন্ত পেপারটা হাতে নিয়ে সিরিয়াতে ফেলা দু'তিনটা বোমা ফেলা এবং এতে কতক "মুক্তির শেষ শান্তির নিঃশ্বাসত্যাগকারীদের!!!" কথা একদম পানসে করে দিল মন৷ সভ্য দু'একটা ভাষা মানে শব্দ উচ্চারণ করতে করতে "মরার উপর খারার ঘা" মারলাম "জননী" বইটি হাতে নিয়ে৷ শতকত ওসমানের লেখা৷(ছদ্ম নাম শওকত ওসমান, প্রকৃত নাম হচেছ, শেখ আজিজুর রহমান। জন্ম ১৯১৭- মৃত্যু ১৯৯৮ইং ) ইতোমধ্যে অনেকেই জানেন হয়ত...পড়েছেনও৷ বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত লেখক।

মনটাকে বিক্ষিপ্ত করে দেবার সকল আয়োজন হয়ে গেল৷ এই বইটি উপহার দিয়েছিলাম এক অগ্রজকে, পড়তে এনেছিলাম..৷ সখ করে শুভেচ্ছাবাণী হিসাবে লিখেছিলাম "জন্ম তব হোক সার্থক"৷ পদে পদে এখন বুঝছি...সার্থকতার সংগা এখন বিভিন্ন....তবে কোন সঙ্গায় সঙ্গায়িত করব এই জন্ম কে!! নাহ...আবারো খেই হারাচ্ছি৷ এই কোহিয়েরেন্স মেইনটেইন করা দেখি আমার পক্ষে কোনভাবেই সম্ভবকর হচ্ছে না!!
যাক্ গে..."জননী" নিয়ে কোন রিভিউ লিখতে যাচ্ছি না৷ আগেই বলেছি...এটা নিতান্তই সাধারণের দৃষ্টি৷


"জননী" তিনটি অক্ষর যার গাঁথনি..."মা" এখানে তো মাত্র একটি৷ কিন্তু মর্মার্থও কি এতো হালকা..সহজ!! এই উপন্যাসটির নামকরণ বড় সার্থক৷ এর পাতায় পাতায় যে জীবনের চিত্র অঙ্কিত...সেখানে ভাঁজে ভাঁজে...গ্রাম্য মায়ের ভালোবাসার হাজারো রঙ৷ কখনো কষ্টের, ভালোবাসা, আনন্দের৷ কখনো শাষন, তীরস্কারের, কখানো আশ্রয়, প্রশ্রয়ের৷ অবশ্য আরোও অনেক জীবনের কাহিনীও বর্ণিত৷

মূল চরিত্রগুলো... এক স্বার্থহীন জননী দরিয়াবিবি, একদা সম্বান্ত পূর্বপুরুষদের বংশধর হতদরিদ্র নিঃস্ব চাষী আজহার, দুরন্ত আবেগী আমজাদ (দরিয়াবিবির ছেলে), পাগলা চন্দ্র, যে জানে অসহ্য ব্যথায় হাসতে৷

আরোও কিছু উল্লেখযোগ্য চরিত্র আছে...দরিয়াবিবির প্রথম ঘরের সন্তান মোনাদির, আশেকজান, হাসুবৌ, শৈরমী, এলোকেশী, আমেরন চাচী, লম্পট অথচ যত্ন ও শান্তির কাঙ্গাল ইয়াকুব৷ মনে একদম...ছুরি বসিয়ে দাগ কাটা যাকে বলে...সেরকম কিছু দৃশ্যের কথা বলছি....

উপন্যাসটির এক জায়গায় বৃদ্ধা সহায়-সম্বলহীন অন্যের দখ্যিনায় দিনযাপনকারী আশেকজানের প্রতিবিম্বকে দরিয়াবিবির দৃষ্টির দ্বারা পাকা হাতে দেখিয়েছেন শওকত ওসমান৷

"দারিদ্র্যের নারী-প্রতীক যেন ওই গৃহকোণে আশ্রয় লইয়াছে৷ আল্লাহর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষের জীবন৷ এই তার পরিনতি! দরিয়াবিবি অসোয়াস্তি অনুভব করে৷ দারিদ্র্যের দাবানলে সংগ্রাম বিক্ষুদ্ধ জীবনের সমগ্র ঐশ্বর্যসম্পদ ভস্মীভূত হইয়া গিয়াছে৷ লোলচর্ম কোটরাগত চক্ষু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে মানুষের আত্মার দিকে চাহিয়া আছে মাংসলোভী কুকুরের মত৷" 

দরিয়াবিবির সংসারের চিত্র দিনকে দিন খারাপের দিকে আর এরই মাঝে আজহার ভাগ্য অন্বেষনের দায়ে পাড়ি জমায় ভিন্ন জায়গায়, শহরে৷ দরিয়াবিবিকে সংসারের পেট চালাবার দায়ে ছোট্ট আমজাদের ঘাড়ে দায়িত্বের বোঝা ফেলতে হয়৷ যার লেখাপড়া নিয়ে ছিল হাজারো স্বপ্ন...."তুমি কি আর স্বপ্ন দেখো না দরিযাবিবি?" প্রশ্নটা কাকে করা??

ভিন্ন ধর্ম...তবুও এদের সম্পর্ক যেন হৃদয়ের....চন্দ্রের সাথে আজহারের, দরিয়াবিবির সাথে শৈরমী৷ একসময় প্রচন্ড বাধ্য হয়ে পিতলের ঘড়া বন্ধকের জন্য শৈরমীর শরোনাপন্ন হয়...দরিদ্র কিন্তু শক্ত ব্যক্তিত্বের দরিয়াবিবি৷ যে কিনা দান দখ্যিনার ছায়া থেকে নিজের মান বাঁচিয়ে চলে৷ সেই শৈরমীর শেষ নিঃশ্বাসত্যাগের সময়...শরা-শরিয়তের বেড়ি বাধা পোয়াতি দরিয়াবিবি, রাতের আঁধারে স্বামীর অগোচরে তাকে দেখতে যাবার সাহস কোথা থেকে পায়!! এ কেমন টান!!

" রক্তমাংসের নিচে মানুষে মানুষে সঙ্গীভূত হওয়ার যে পরিপ্লাবী উত্‍সধারা যুগ-যুগান্তের শিকড় উত্‍পাটন করিয়া নব নব সভ্যতার বীজ ছড়াইয়া যায়- তারই সর্বস্বীকারহীন চঞ্চল আর্তনাদ তরঙ্গের মতো দরিয়াবিবির বুকে আছড়াইয়া পড়িতেছিল৷ তারই আহবান তো এতো নিশীথ রাত্রে ঘরছাড়া করিয়া আনিয়াছে তার মতো গর্ভবতী জননীকে৷" 

অবশ্য পেটের এই সন্তানটির নাম শৈরমীর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য রাখা হয়...শরীফন, ডাক নাম শরী৷
"শৈরমীর স্মৃতি একবার তার মনে জাগিয়াছিল বৈকি৷ সেই দীন-জীবনের করুন অবসান-মুহূর্ত! ডাক নামে শৈরমীর স্মৃতি বাঁচিয়া থাকে৷ দেশের বিশাল মানচিত্রের এক কোণে নামহীন গ্রাম্য জননীর দীন প্রচেষ্টা-জাতি-ধর্ম যেখানে মানবতার উপর নৈরাজ্যের কোন ফণা মেলিতে পারে না৷" 

এই "ডিভাইডেট রুল"...কাল সাপের ন্যায় সব শতাব্দীতেই কি পিছু পিছু চলবে আমাদের...মানবসভ্যতা টিকে থাকবে যতদিন!! মহেশডাঙার হতদরিদ্র মানুষগুলোর...দাম্ভিক, ক্ষমতালোভী কিছু পশুদের খেলার পুতুল হবার খানিক দৃশ্যও এই উপন্যাসে অঙ্কিত..সঙ্গতকারণে৷ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা৷ যেখানে বিভ্রান্ত হয় ক্ষণিকের জন্য চন্দ্রের মতো মানুষও, তবে নির্বিকার সহনশীলতা দেখায় আজহার৷ কিন্তু এই ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষটিও বড্ড খেপে যায়, যখন নিজের ধর্ম নিয়ে কথা উঠে৷ হিংস্ররুপটির পরিচয় ঘটে লা-মজহবী আর হানাফীদের কলহের সময়৷
তবে এখানে চন্দ্রের স্ত্রী এলোকেশীর ভাবনাগুলো চন্দ্রের মতো ঘোর লাগানো নয়৷ আজহার যখন চন্দ্রের সাথে দেখা করতে যায়..চন্দ্র নির্বাক থাকে৷ এড়িয়ে যায় আজহারকে৷ সেখানে এলোকেশী বলে...

"লোক এল, কথা বল৷ গাঁয়ে হিন্দু-মুসলমান ঝগড়া তো ভাইয়ের সঙ্গে কী৷ যতসব অপসিষ্টি, হতচ্ছাড়া লোক৷"

যত বড় বড় দাঙ্গা হয়েছে...তাতে ঘর কোন নেতাদের, দাঙ্গা সৃষ্টিকারী, উত্‍সাহকারীদের পোড়েনি...আগুন কোন ক্ষমতালোভীদের আঙিনায় জ্বলেনি৷ জ্বলেছে...সাধারণ, অসহায় মানুষদের৷ ঘর, ইজ্জত, মান-সম্মান সব ধুলোয় মিশেছে সাধারণদের...যারা শান্তিপ্রিয়৷ কাছের হতদরিদ্র বন্ধু শিবু আর ইসমাইল যখন এই দাঙ্গার কারণে মারা যায়, তখন বোধদয় ঘটে চন্দ্রের৷
আত্মভোলা, নিঃস্বার্থ মানুষটি গেয়ে উঠে-

"ভগবান, তোমার মাথায় ঝাঁটা, ও তোমার মাথায় ঝাঁটা৷
যে চেয়েছে তোমার দিকে, তারই চোখে লঙ্কা-বাটা৷
ও ছড়িয়ে দিলে, ছড়িয়ে দিলে, মারলে তারে তিলে তিলে,
ও আমার বৃথা ফসল কাটা, ও তোমার মাথায় ঝাঁটা৷"

তার এই বোধদয়ের কারণ আজহার যখন জানতে চায়...অশ্রুর ফোঁটা ফেলে চন্দ্র বলে-
"ওদের বাড়িতে কি কান্না৷ শিবুর বৌ ছেলেপুলে নিয়ে হয়ত না খেয়ে মরবে৷ রোহিণী আর হাতেম শালার কি আসে যায়৷ আমার চোখ খুলে গেছে কাল সদরের হাসপাতালে৷"

বুদ্ধিহীন, অন্ধ, অশিক্ষিত-শিক্ষিত গোঁড়া, দরিদ্ররাই সব সময়ই হাতের খেলনা হয়...রোহিণী আর হাতেমদের মতো ক্ষমতালোভী কুকুরদের৷ দাঙ্গায় রক্তের গঙ্গা তাদেরই বয়ে যায়৷ লোভী কুকুরদের একটা চুল পর্যন্তও বাঁকে না৷

"জননী"র প্রধান চরিত্রই কিন্তু দরিয়াবিবি...তাকে যতটুকু যেভাবে আমার বোঝার দরকার...বুঝে নিয়েছি৷ কিন্তু কিছুই লিখতে পারছিনা তাকে নিয়ে!! কেননা মনে হচ্ছে.. ফাঁক থেকে যাবে৷ লিখতে পারবোনা৷ এটা পাঠকদের বুঝতে হবে৷ এ এতো গভীর, যে ডুব দেয়া আমার মতো নগন্যের পক্ষে সম্ভব নয়৷ কি বলব....এই জননীকে নিয়ে?? যে জননী... সন্তানদের বুঝতেও দেয় নি, অন্নের ভাগ তার নেই! যে জননীর দিন শুরু হয় এই চিন্তা করেই যে সন্তানদের মুখে কি তুলবে...সংসারে শ্রী আদৌও আনা যাবে কি না! আর রাত কখনো কখনো নির্ঘুম!! যে জননীর কপালে একটু জিরিয়ে নেবার সময়টুকু হয় না, কপালে জোটে না আঁতুর ঘরের বিশ্রামটুকুও!! যে শক্ত কঠোর, আপোসহীন জননী, সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে পেটের দায়ে, দয়া দখ্যিনার চাল গ্রহণ করে...যা ঘৃণাভরে এতোদিন প্রত্যাখান করেছিল! যে জননী, স্বামীর মৃতু্যর পর সহায় সম্বল হারিয়ে, অকূল সাগরে ভেসে থাকবার জন্য মিথ্যে আশ্রয়কে আঁকড়াতে চায়, পাথরের মতো মেনে নেয় লাঞ্চনার জীবন৷ লম্পট, লোভী ইয়াকুবের দহন সহ্য করাটাই শ্রেয় মনে করে....সন্তানগুলোর দিকে তাকিয়ে! সবশেষে নিপূনভাবে, সবার অগোচরে জন্ম দেয় তার জঠরের শেষ সন্তাটিকে, যাকে এতোদিন লুকিয়ে রেখেছিল সবার নজর থেকে! যাকে সমাজ "জারজ" নামে গ্রহন করবে, আর দরিয়াবিবি যার জন্মের জন্য খেতাব পাবে...কলংকিনীর!!!
"দরিয়াবিবির চতুর্দিকে অন্ধকারের নৈরাজ্য৷ অন্ধকারই অন্ধকারের পরিসমাপ্তি ঘটায়৷ নচেত্‍ অভ্যস্ত জীবনে মানুষ আনন্দ পাইত কি করিয়া?"

দরিয়াবিবির কবরের গোঁড়ায় দাঁড়িয়ে মোনাদির যখন বলে উঠে- "মা গো, তোমার বুকে একটু ঠাঁই দিও৷"চোখের জলগুলো ধরে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি৷ লেখকের সার্থকতা এখানেই৷ চরিত্রগুলোর সাথে... মনের অজান্তেই একাত্বতা গড়ে দিয়েছেন৷ নাহ...উপন্যাসটির মূল যিনি তাকে নিয়ে বেশি কিছু বলব না৷ নোনতা স্বাদ নেবার আর খায়েস নেই৷ উপন্যাসটির শেষের দৃশ্যগুলো খুব লাগছে বুকে...চাপা এক ব্যাথা৷ যারা পড়েছেন...তারা খুব ভালো করেই আমার অপরাগতা বুঝতে পারবেন৷ আর যারা পড়েন নি...অনুরোধ অন্তত একবার হলেও পাতাগুলো উল্টে দেখবেন৷ দরিয়াবিবির জন্য...জননীকে জানার জন্য৷

সোমবার, ১৪ মে, ২০১২

প্রথম সাক্ষাতে...নাগিব মাহফুজ (Wedding Song...)


নাটকের রস আস্বাদন সবার পক্ষে নাকি সম্ভব নয়। হয়তবা সত্যি। তবে আমার ক্ষেত্রে ১০০% খাঁটি সত্য। নাটকের চেয়ে উপন্যাস অনেক টানে। তবে হ্যাঁ, অ্যাপ্রিসিয়েট করি মঞ্চ নাটকের অভিনেতাদের বেশি। এর কারণ দর্শাবার প্রয়োজন আদৌ আছে বলে মনে হয় না। যাই হোক্, পৃথিবীতে এমন অনেক সাহিত্যিক আছেন, যাদের সাহিত্য এক একটি মাস্টারপিস। তবে কোন কোন সাহিত্যিক অগোচরেই থেকে যায়, আবার কেউ কেউ আধুনিক উন্নত কমিউনিকেশনের বদৌলতে দৃষ্টিগোচর হয়।
তাই বলে কিন্ত নাগিব মাহফুজকে দৃষ্টির অগোচরে থাকা হিসাবে বলছিনা। ওটাতো আমার মত বাঙালী পাঠকের ব্যর্থতা। 
"নাগিব মাহফুজ" (জন্ম ১১ই ডিসেম্বর ১৯১১- মৃত্যু ৩০ আগস্ট ২০০৬ইং) একজন ইজিপ্টশিয়ান লেখক, মিশরের কায়রো শহরে জন্ম। ১৯৮৮ ইং সালে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী। ৭০ বছরের ক্যারিয়ারে ৫০টি নোভেল, প্রায় ৩৫০টি ছোট গল্প, ৫টি নাটক এবং ডজনখানেক মুভি স্ক্রিপ্ট তাঁর কলম থেকে এসেছে। খুব অল্পের উপর বলতে গেলে এই হচ্ছে তাঁর কর্মজীবনের ফসল। ব্যক্তিগত জীবন ঘেঁটে দেখার ইচ্ছে এই লেখাতে নেই। তবে হয়তবা, তাঁর ব্যক্তিগত জীবনী শেষ করা যাবে অল্প কথায়, কিন্তু তাঁর সৃষ্টিকর্মের বর্ণনা বা বিশ্লেষণ স্বল্প কথায় ব্যক্ত করবার মতন নয়। এবং অবশ্যই সেই ধৃষ্টতা দেখাতেও যাবো না।

শুরুর দিকে নাটকের কথা বলেছিলাম, কেননা গেল কিছুদিন আগে, "নাগিব মাহফুজ" এর সান্নিধ্যে আসি তাঁর রচিত "Wedding Song"- "বাসর-গীতি", কবীর চৌধুরীর অনুবাদকৃত বইটির মাধ্যমে। এই গল্পের কাহিনী মঞ্চের অভিনেতা-অভিনেত্রী, কলাকৌশলীদেরকে ঘিরেই আবর্তিত। এ যেন এক জবানবন্দীর দলিল। যেখানে প্রত্যেকেই নিজের সত্ত্বার কাছে জবানবন্দী দিচ্ছে। যেন নিজের প্রতিবিম্বকে বোঝাচ্ছে "প্রকৃত আমি কি....দেখ, বোঝ"! এক কথায় সাফাই গাওয়া আর কি! একদমই ইনটারনাল কনভারজেশন। নাগিব মাহফুজের সার্থকতা এখানেই। প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের জবানবন্দীতে, তাদের স্বাতন্ত্রতা স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা। চরিত্রগুলো যখন কথা কইছে, তখন বোঝাই যাচ্ছেনা তাদের সৃষ্টির উৎস, জঠর এক। মনে হচ্ছে যেন, নাটক মঞ্চের লোকগুলো এঁটে থাকা মুখোশ খুলছে, একজন আরেকজনের। আবার কখনো কখনো নিজেরাই নিজেদের প্রসাধনের আস্তরণ খসানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। প্রতিটি চরিত্রই যার যার আপন, কদর্য বাস্তব নিয়ে কথা বলে। যেখানে আছে ধূসর হয়ে যাওয়া স্বপ্ন, না-পাওয়ার হাহাকার, বিলাপ।
 
জবানবন্দী যে চরিত্রগুলির...তারা হচেছ..তারিক রমাদান, করম ইউনিস, হালিমা আল বকস, আব্বাস।
প্রতিটি জীবনে প্রত্যেকেই এক একজন প্রধান হয়ে থাকে, এটাই ধর্ম। আর এখানেও তাই। সবাই কেন্দ্রীয় চরিত্র। কিন্তু তারপরও একটা চরিত্রকে মূখ্য করবার সুক্ষ্ম একটি প্রয়াস "নাগিব মাহফুজ" এর কলমে দেখা যায়। "আব্বাস"!! মূলত এটি জবানবন্দীর দলিল হলেও একজনের প্রতি দূর্বলতা নাগিব মাহফুজ ঢাকতে পারেন নি। দোষ তাঁকে দেয়াও যায় না। কেমন করে যেন...সবার মাঝে থেকেও এই চরিত্রটি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে তার স্বকীয়তায়। তার ব্যক্তিত্বের দৃঢ়তায়। যে সমাজ, যে পরিমন্ডল থেকে এই জবানবন্দীর দলিল বেড়িয়ে এসেছে, সেখানকার পারিপার্শ্বিকতায় এ চরিত্র একদমই বেমানান। ধোঁকা, প্রবঞ্চণা, অপরাধ, নোংরামী যেখানে নৈমিত্তিক....সেখানে এই শিল্পপ্রেমিক যেন গোবরে পদ্মফুল। হয়তবা সৃষ্টির কামনায় প্রজ্জ্বলিত বলেই এই চরিত্রের উপর দূর্বলতা নাগিব মাহফুজের...যিনি নিজে বিয়ে করেছিলেন ৪২ বছর বয়সে। কারণ দর্শিয়েছেন..."তাঁর সৃষ্টিকর্মে যেন কোন বাধা তৈরি না হয়।"
"আব্বাস" এত আলাদা করে কেন নজরে লাগবে?? কারণ খুব অল্প সময়েই তার জীবন শুধুই ব্যর্থতার স্বাদ পায়...আর ছেলেবেলা থেকে তো বঞ্চনা ছিল তার সঙ্গী। ব্যর্থ স্বপ্ন, অতি কাংখিত সুখের সাওর থেকে ছিটকে পরে অসীম একাকিত্বের চোরাবালিতে ডুবতে থাকে। যেখানে হাল ছেড়ে দেবার তীব্র বাসনা তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নিজেকে সঁপে দিতে চায় আত্মহননের হাতে।

"এই হল একাকিত্ব: একটা নীরব বাড়ি, স্মৃতি আর প্রেতাত্মায় পূর্ণ একটা হৃদয়, শুধু দু:খে বিধ্বস্ত নয়, পাপবোধ দ্বারাও, কারণ যে বরফ শীতল বাস্তবতা স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে তা আমার কানেও ফিস ফিস করে বলে দেয় যে, আমার কামনাগুলো এখনোও বাস্তবায়িত হয় নি। আমাকে আরোও তীব্রভাবে শোকার্ত করলেও আমার কল্পনাগুলো ভুলে যেতে চাই। তবু শোক যখন তীব্র হয়, যখন ঝাঁপিয়ে পড়ে গভীরতম তল স্পর্শ করে তখন তা থেকে একটা বিচিত্র প্রমত্ততা উদ্ভাসিত হতে শুরু করে এবং তা এক ধরনের সান্ত্বনাও নিয়ে আসে..."

আত্মহননের পথে পা বাড়াবার সময়, তার শিল্পসত্ত্বা নতুন এক আলোর ঝলকানির শেষ সার্থক চেষ্টা চালায়, বেঁচে থাকবার নতুন আবরণটি দেখায়....তার ব্যর্থ সত্ত্বাকে ঢিঙিয়ে জয় হয় তার শিল্প সত্ত্বার।

"আমি এক ঘন্টা নয়, একটা যুগ ঘুমিয়ে কাটিয়েছি। ওই যুগ থেকে আমি জেগে উঠেছি একটা নতুন যুগে। আমার ঘুমের মধ্যে একটা কিছু ঘটে গেছে, এতো মহার্ঘ্য ও তাৎপর্যপূর্ণ যে এই আকস্মিক নিরাময়ের আনন্দ না দেখা দিলে, যে আনন্দ স্মৃতির মৃত্যুমুষ্টিবন্ধন শিথিল করে দিয়ে অমূল্য বস্তুনিচয়ের স্মৃতিকেন্দ্র বিস্মৃতির গর্ভে ছুড়ে দিয়েছে, আমি হয়ত এই অলৌকিক পরিবর্তনের শুরুর সামান্য একটু আভাস অন্তত স্মরণ করতে পারতাম।"


"এই পরমানন্দের অনুভূতি, একটা সৌভাগ্যবহ কবচের মতো আমি আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। তার রহস্যময়তা নিয়ে এর শক্তি অতলস্পর্শী হয়ে থাকুক। দেখ, ওই যে, এর প্রাণদায়ী শক্তি বিজয়ের সুরভি সাথে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে!"

যারা জীবনের চলার পথে হার মেনে অপদার্থের মত পরে যেতে চায়, তাদের জন্য -

"চরম দারিদ্র্য একটা শরীরকে সম্পূর্ণ নিঃস্ব করে দিয়েছে, তার নিজের উষরতা ছাড়া সেখানে আর কিছু নেই। কিন্তু একটা ইচ্ছাশক্তি আছে, আনন্দের এই চ্যালেঞ্জ তাকে মুক্তিদান করেছে, এই পরমানন্দ এখন জ্বলজ্বল করতে থাকুক তার শীর্ষবিন্দুতে।"


"নাগিব মাহফুজ" একটা অদ্ভুদ সত্য বলেছেন এখানে....

"একজন আদর্শবাদীর চেয়ে বেশি নিষ্ঠুর আর কেউ নেই। এই পৃথিবীর যাবতীয় হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী কে? আদর্শবাদী।"


প্রত্যেক সাহিত্যিকদের নির্দিষ্ট উপাদান, ভিন্ন ভিন্ন ইনগ্রিডিয়েন্স থাকে, যা তার সাহিত্যের স্বকীয়তা তৈরী করে। "নাগিব মাহফুজ" এর ক্ষেত্রে বলা হয়েছে "সময়"। তার উপন্যাসগুলোতে কালের ভূমিকা অনেক। যেমন---

"সময় একটা ভয়ংকর সহযাত্রী", "সময় আমার বন্ধুর একী অবস্থা করেছে? তার মুখে একটা বীভৎস মুখোশ এঁটে দিয়েছে।"
 
যাক্ গে...শেষ করছি...১৯৮৮ সালে নোবেল পুরস্কার প্রদানের সময় সুইডিশ একাডেমিকৃত নাগিব মাহফুজের সাহিত্যকৃতি সম্পর্কে মন্তব্যটি দিয়ে---

".......thorough works rich in niuances--now clearsightedly realistic, now evocatively ambiguous--(Mahfooz) has found an Arabic narrative art that applies to all mankind."

রবিবার, ১৩ মে, ২০১২

অবরোধ-বাসিনী......"The Women in Captivity......."


"বাঙ্গালী জাতির জাতীয় প্রেরণাই তাঁহাকে পরিচালিত করিয়াছিল৷...আশ্চর্যের বিষয় এইযে, এই প্রেরণা এমন করিয়া একজন নারীকেই আশ্রয় করিয়াছে- বাঙ্গালী মুসলিম সমাজের আত্মা এবং বিবেক বুদ্ধি এমনভাবে একটি নারী প্রতিমারুপে প্রকাশ পাইয়াছে৷ একালে হিন্দু সমাজেও এমন নারী চরিত্র বিরল৷"
- মোতিললাল মজুমদার

"শুধু মুসলমান সাহিত্যিকদের মধ্যে নয়, গোটা বাংলার নারী সাহিত্যিকদের মধ্যে তাঁহার স্থান অতি উচ্চে৷"
- কাজী আবদুল ওদুদ৷

"তাঁহার মত চিন্তাশীলা নারী প্রকৃতই শুধু নারী জাতি কেন, সমগ্র মানব জাতির গৌরবের পাত্রী৷"
- আবুল হুসেন৷

"অবরুদ্ধ মুসলমান অন্ত:পুরে এহেন শাণিতবুদ্ধি প্রেমপরায়ণারুপি সুন্দর প্রতিভার আবির্ভাব বিস্ময়কর ব্যাপার৷"
- আব্দুল কাদির৷

ইস্পাত....How the Steel was Tempered....


এই ভরদুপুরে লোডশেডিং এর অত্যাচারে অতিষ্ট। ঠান্ডা পানি গলায় ঢালার তীব্র ইচ্ছে অবদমিত হচ্ছে...মুখে ঠান্ডা পানির ঝাপটায়। ভাবছি, ইচ্ছে করলেই ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি দুপুরটা। কিন্তু আজকাল মনে হয় যতটুকু সময় জীবনের আছে...সেন্স নিয়ে বাতাসগুলো শুষে নিয়ে সময়ের কাছ থেকে নিগ্রে নিতে থাকি না কেন...যখন যা পাই!!
পা ঘোরালাম লাইব্রেরীর দিকে, হাত বাড়াচ্ছি ডিটেকটিভ টাইপের একটা বইয়ের দিকে কিন্তু নজর চলে গেল..."ইস্পাত" এর দিকে। "ইস্পাত"...সাহিত্যের বাস্তব ঘরানার সবচেয়ে শিক্ষনীয়, সবচেয়ে উজ্জ্বল, সবচাইতে মর্মস্পর্শী একটি সাহিত্য যার স্রষ্ঠা "নিকোলাই অস্ত্রভস্কি", "Nikolai Ostrovsky" (জন্ম ১৯০৪- মৃত্যু ১৯৩৬)। আমার বাস্তব ঘরানোর সাহিত্য শিক্ষার প্রথম ধাপগুলোর মধ্যে, এই অমর সৃষ্টি একটি। বইটি হাতে নিয়ে নতুন করে পাতা উল্টাতে খুব মন চাইলো।




সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...