শুক্রবার, ১২ ফেব্রুয়ারী, ২০২১

ঠাকুরবাড়ীর আঙিনায়-জসীম উদ্দীন


 "যে সব কবিতায় এই আলো-আঁধারীর ছায়া থাকে, বোধহয় সেগুলোতে রস-উপভোগের একটি অপূর্ব আস্বাদ থাকিয়া যায়।"



রবীবাবুর লেখা পড়ে এই উক্তি ছিল, জসীম উদ্দীন এর। "ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়" জসীম উদ্দীন দেখেছেন রবীবাবু আর অবনীন্দ্রনাথকে এক ঘরোয়া চোখে। আরও অনেক ব্যক্তিবর্গের কথাও উঠে এসেছে সযতনে। বইয়ের শেষে বিদ্রোহী কবিকে নিয়েও লেখা আছে, স্বাভাবিকভাবেই কেঁদেছি।
বিদ্রোহী কবির জীবনের অনেক বাঁকগুলো কান্না করতে বাধ্য করে। জসীম উদ্দীন লিখেছেন, কবি নজরুল যখন তার প্রথম ছেলে বুলবুলকে হারান, শত চিহ্ন জড়িত ঘর থেকে পালিয়ে কবি যেতেন ডি. এম লাইব্রেরীর কোলাহলের মাঝে, পল্লী কবির ভাষায়,


"যদি তিনি মনের সুখে 'সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে' লিখিতে পারিতেন, তবে সেই লেখা আরও কত সুন্দর হইতে পারিত।"


আমি "সৃষ্টি-সুখের উল্লাসে" আবারও আওড়াই, কি করে পেরেছিলেন কবি তা লিখতে। ভেঙ্গে যাওয়া হৃদয় নিয়ে এই রচনা সম্ভব!
সম্ভব, এদের দ্বারাই সম্ভব।
পল্লী কবি লিখেছেন,

"অপর কাহাকেও প্রশংসা করিতে পারিলে তিনি যেন কৃতার্থ হইয়া যাইতেন। অপরকে হেয় করিয়া নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করিতে তিনি কোনদিনই প্রয়াস পান নাই।"

বিদ্রোহী কবির বেদনাবহুল কিছু ঘটনাও জসীম উদ্দীন বর্ণনা করেছেন। যা পাঠককে নিজের মতন পড়ে নিয়ে ভাবতে হবে। কতই না অমানুষ হয়ে যাই আমরা কখনো কখনো। কষ্ট লাগে বিদ্রোহী কবির মাতৃতুল্য সেই হিন্দু রক্ষণশীল শাশুড়ি মায়ের কথা শুনে। সমাজ তাকে ভালোই মূল্যায়ন করেছিল!

ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহলের কথা জানতে গিয়ে কিছু জানলাম পল্লী কবির জীবনের গানও, বিশেষ করে তার কৈশরের সেই ছোট্ট মনের কত স্বপ্ন, হতাশা, অপমান, কষ্ট। ঠাকুরবাড়ির অন্দর মহলে যাতায়াত শুরু হয় তার বন্ধুবর মোহনলালের হাত ধরে। জসীম উদ্দীনের লেখা পড়ে রবীঠাকুর মোহনলালকে চিঠিতে জানান,

"জসীম উদ্দীনের কবিতার ভাব ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নতুন ধরনের। প্রকৃত হৃদয় এই লেখকের আছে। অতি সহজে যাদের লেখবার শক্তি নেই, এমনতর খাঁটি জিনিস তারা লিখতে পারে না।"


একটা চমতকার কথার উল্লেখ আছে, পল্লী কবি লিখেছেন, রবিঠাকুর খুব কষ্ট নিয়ে বলেন, তাকে নিয়ে অনেকেই যা খুশি, যখন তখন লিখেন। পল্লী কবির উত্তর ছিল,

"আপনি কবি, সাহিত্যিক, - আপনাকে নিন্দা করেও সাহিত্য তৈরী হয়। তাই আপনার নিন্দা করা সহজ।"


রবিঠাকুরের আক্ষেপ, লোকে মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে তো নিন্দে করে না।
পল্লী কবির উত্তর,

"মহাত্মা গান্ধী বিশিষ্ট ব্যক্তি হলেও তাকে নিন্দে করে সাহিত্য তৈরী হয় না। আপনার সঙ্গে আপনার নিন্দুকেরাও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চায়।"

এই স্থানে পড়ে আনমনেই হাসলাম, বাপুজীকে ভারতের মাটিতে এখন যা শুনতে হয়, রবিবাবু বাকহীন হয়ে যেতেন। আক্ষেপ করবার তো প্রশ্নই উঠেনা।


রবিবাবুকে নিয়ে পল্লী কবির উক্তি,

"কবির কাছ হইতে যখন ফিরিয়া আসিতাম, মনে হইত কোন মহাকাব্য পাঠ করিয়া এই ক্ষণে উঠিয়া আসিতেছি। সেই মহাকাব্যের সুরলহরী বহুদিন অন্তরকে সুখস্বপ্নে ভরিয়া রাখিত।"

 

"কবির মৃত্যু নাই একথা সত্য কিন্তু কবির সংস্পর্শে আসার সুযোগ যাহাদের হইয়াছে, তাহাদের মনের শূন্যতা কেহ কোনদিন পূরণ করিতে পারিবে না।"


পল্লী কবি অবনঠাকুরের সেই অনবদ্য চিত্রশিল্প "শাহাজাহনের মৃত্যু" তৈরি হবার কাহিনীও বর্ণনা করেছেন। বলা বাহুল্য পড়বার পর, নতুন করেই যেন সেই চিত্রকে আবিস্কার করি। মহান এই শিল্পীরা কী করে পারতেন! তাদের শিল্প তাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণের উপর নির্মাণ বলেই কি অমর!

পল্লী কবি, ঠাকুরবাড়ির কাহিনীর যবনিকা ঘটান এই শেষ কথাগুলো দিয়ে,


"প্রদীপ নিবিয়া গিয়াছে, মহানাটকের চরিত্রগুলি আজ একে একে বিদায় লইতেছেন। এ কাহিনী আর দীর্ঘ করিব না। যে নিয়োগ-ব্যথা আমার অন্তরের অন্ত:স্থলে মোহময় কান্নার বাঁশী বাজইয়া সেই অতীতকাল হইতে ছবির পর ছবি আনিয়া আমার মানসপটে দাঁড় করায়, তাহা আমরই নিজস্ব হইয়া থাকুক। লোকালয়ে টানিয়া আনিয়া আর তাহা ম্লান করিব না।"

পড়ছিলাম, পল্লী কবির "ঠাকুরবাড়ির আঙিনায়"।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...