সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (9th Part)

পর্ব-৯

~সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~


বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের সাতটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা, জাহিলিয়াত, শারিয়া, জিহাদ, খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।




এই সিরিজের পর্ব-৩ এ জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তা সংক্ষিপ্তভাবে ইতিমধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। জাহিলিয়াতের ধারণা যেহেতু উস্তাদ মওদূদীর মতাদর্শ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেহেতু পর্ব-৭ ও ৮-এ এই ধারণা প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। আজকের পর্বে জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে মওলানা নাদভীর ধারণার আরো বিস্তার করা হচ্ছে। পরে বই হিশেবে যখন এই লেখাগুলি সংকলিত ও সম্পাদিত হবে তখন এই সংযোজনাগুলো পর্ব-৩ এর প্রাসঙ্গিক অংশে যুক্ত হবে।

১০. পুনশ্চঃ মওলানা নাদভীর জাহিলিয়াত ধারণা প্রসঙ্গে আরো তথ্য ও বিশ্লেষণ
নাদভী – ইসলাম-পূর্ব জাহিলিয়াতকে নাদভীও খুঁটিনাটি অনুষঙ্গসহ বর্ণনা করেছিলেন। এ কাজ তিনি তার ইতিহাস বিষয়ক রচনায় যেমন করেছেন তেমনি আকিদা, ঈমান ও ইসলামের রোকন বিষয়ক রচনাতেও করেছেন। আসলে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ইসলামের বৈপ্লবিক আগমন ও ভূমিকা পর্যাপ্তভাবে পরিস্ফুট হয় তখনই যখন তা প্রাক-ইসলামী যুগের জাহিলিয়াতের বিপরীতে উপস্থাপিত হয়। নাদভী ইসলামের অন্য সকল ইতিহাসবিদের মতই এই রীতি অনুসরণ করেছেন। তার ‘মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল?’ গ্রন্থটির বিষয় বিন্যাসকে বিশ্লেষণ করলেই এটি পরিস্কার বোঝা যায়। সেখানে তিনি ইসলামের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট পরিস্ফুট করার জন্য প্রাক-ইসলামী আরব জাহিলিয়াতের প্রতিটি খুঁটিনাটি অনুষঙ্গসহ উপস্থাপন করেছেন। এভাবে তার ইতিহাস কাঠামোতে জাহিলিয়াত ও ইসলাম একটি অসম ও বিপ্রতীপ প্রত্যয়-যুগল হিশেবে বর্ণিত হয়েছে। এই প্রত্যয়-যুগলের পারস্পরিক সম্পর্ক যে হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের আরেকটি প্রকাশ সেটি তার উপস্থাপনায় স্ফটিকস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। এই দ্বন্দ্ব ও দ্বৈরথ যে ইতিহাসের একটি চলমান প্রক্রিয়া সেটিও তিনি তার বিষয় বিন্যাস ও বিশ্লেষণে বারবার উন্মোচিত করেছেন। জাহিলিয়াত তার ইতিহাস দর্শনে অন্ধকার বা অমানিশার প্রতীক ও যুগ হিশেবে পরিগণিত হয়েছে। এই জাহিলিয়াত বা অন্ধকার ভেদ করে ইসলামের আগমন একটি নতুন আলো ও যুগের বার্তা বহন করেছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। তৎকালীন পারস্য ও বৈজন্তীয় সভ্যতাকেও তিনি সদ্য আবির্ভূত ইসলামের বিপরীত হিশেবে এই জাহিলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত করে দেখিয়েছেন।

তিনি জাহিলিয়াত যুগের আরবদের সম্পর্কে লিখেছেনঃ “...একসময় তারা ভীষণভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছিলো। কারণ একদিকে তারা নবুওয়তের আসমানি শিক্ষা থেকে অনেক দূরে ছিলো, অন্যদিকে জগত-সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বহু শতাব্দী যাবত এক আরব উপদ্বীপেই আবদ্ধ ছিলো। তদুপরি তারা বাপ-দাদার ধর্ম এবং জাতীয় আচার-প্রথা ও কুসংস্কারকেই যুগ যুগ ধরে আঁকড়ে ধরেছিলো।

খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকে তারা অবক্ষয় ও অধঃপতনের এমন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলো, যার নযির সমসাময়িক পৃথিবীতে খুব একটা ছিলো না। মূর্তিপূজা তার যাবতীয় বীভৎসরূপ নিয়ে শিকড় গেড়ে বসেছিলো। বিভিন্ন নৈতিক ও সামাজিক ব্যাধি তাদেরকে ভিতর থেকে খোকলা করে ফেলেছিলো। এক কথায় বলতে হলে বলা যায়, আসমানি ধর্মের অধিকাংশ গুণ-বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য-মহিমা থেকেই তারা বঞ্চিত ছিলো, আবার জাহেলিয়াতের নিকৃষ্টতম দোষ-ব্যাধিগুলো তাদের মাঝে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো। পুরো আরব জাযিরাতে আলো বলতে কিছুই ছিলো না, ছিলো শুধু ঘোর অন্ধকার।” [৩৭]

এরপরে তিনি ইসলামের অগ্রযাত্রাকে বর্ণনা করেছেন ‘জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোতে’ [৩৮] ধাবমান হিশেবে। এভাবে এই যাত্রা তৈরি করেছিল ‘জাহেলিয়াতের কাঁচামাল থেকে মানবতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ’, ‘নতুন ব্যক্তি, নতুন সমাজ’ ও ‘ভারসাম্যপূর্ণ মানবগোষ্ঠী’। [৩৯]। এই যুগকে তিনি বলেছেন ‘ইসলামের সোনালী যুগ’ [৪০] ও ‘মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের যুগ’ [৪১]। কারণ ‘খেলাফতে রাশেদাই হল সর্বোত্তম আদর্শ’ [৪২]।

এরপরে জাহিলিয়াতের ভাবধারার যতই প্রত্যাবর্তন হয়েছে ততই মুসলিম উম্মাহর অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়েছে। নাদভী লিখেছেনঃ “...অনেকেই জাহেলিয়াতের চিন্তা চেতনা ও রোগজীবাণু বহন করতো। ফলে স্বভাবতই জীবন ও সমাজের সর্বত্র তা সংক্রমিত হয়ে পড়েছিলো এবং মানুষ তাদের স্বভাব-চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতাকেই অনুসরণ করতে শুরু করেছিলো। ... ...ফলে ইসলামি সমাজ ও মুসলিম জীবনে জাহেলিয়াত আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং দ্রুত শক্তি বিস্তার করতে লাগলো।” [৪৩]

এ কারণে মুসলিম বিশ্বব্যাপী আবার স্থবিরতা দেখা দেয় এবং এই শূন্যতার পরিসরে আধুনিক শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইউরোপের উত্থান ঘটে। তিনি জাহিলিয়াত ধারণার মাধ্যমেই মুসলিম উম্মাহর এই পতনকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর ফলে বিশ্বের কি ক্ষতি হল তা নিরূপণ করেছেন। সমান্তরালভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার স্বভাব ও প্রকৃতির উন্মোচন ও বিশদ বর্ণনাও তিনি করেছেন। এভাবে তিনি পাশ্চাত্যের উত্থানকে বস্তুবাদ, ধর্মহীনতা, জাতিবাদী সংঘাত, ভোগবাদ ইত্যাদি হিশেবে দেখেছেন এবং এসব কিভাবে ‘উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা’র [৪৪] মধ্য দিয়ে ‘মানবতার আত্মিক বিপর্যয়’ [৪৫] বয়ে এনেছে তিনি তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। ‘সমগ্র বিশ্বের জাহেলিয়াতমুখিতা’ [৪৬] থেকে ফেরত আসার জন্য তিনি ‘বিশ্বনেতৃত্বের আসনে ইসলামের প্রত্যাবর্তন’ [৪৭] হোক সেই আকাঙ্খা উতসাহভরে ব্যক্ত করেছেন। ‘মুসলিম বিশ্বের নব-উত্থান’ [৪৮] কামনায় তিনি ‘শিক্ষা-ব্যবস্থায় নতুন বিন্যাস’ [৪৯], ‘জ্ঞান-গবেষণায় নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার’ [৫০], ‘শিল্প, প্রযুক্তি ও সমরযোগ্যতা’ [৫১] এবং ‘নতুন ঈমান ও আত্মিক প্রস্তুতি’ [৫২] গ্রহণের জন্য ‘আরববিশ্বের কাছে ইসলামী বিশ্বের প্রত্যাশা’ [৫৩] উন্মুখভাবে ব্যক্ত করেছেন।


তাহলে দেখা যাচ্ছে যে উস্তাদ মওদূদীর মত মওলানা নাদভীও জাহিলিয়াতকে একটি স্থান-কাল নিরপেক্ষ প্রত্যয় হিশেবে বুঝেছেন। একারণে জাহিলিয়াত প্রত্যয়ের সাহায্যে তিনি ইসলামের যে পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেছেন সেখানে প্রাক-ইসলামী জাহিলিয়াত এবং আধুনিক জাহিলিয়াত এই দুই জাহিলিয়াতেরই অবতারণা তিনি করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “আমাদের সামনে যখন আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগের নাম আসে তখন চখের সামনে ভেসে উঠে খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকের সেই তমসাচ্ছন্ন যুগ। যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও্যা সাল্লাম। বিকশিত হয়েছিল তা৬র হিদায়েত ও প্রশিক্ষণ। বিশ্ববাসী দেখেছিল তাঁর মুজিযা। জাহেলিয়াত শব্দটি কানে আসলেই ভেসে উঠে চোখের সামনে আরব জাতি, তাদের বর্বতা, লাগামহীন চলাফেরার দৃশ্য। ঐতিহাসিকগণ যার চিত্র তুলে ধরেছেন তাদের গ্রন্থে।

তবে জাহেলিয়াত বা মূর্খতা শুধু সে কালের সাথে বিশেষিত নয়, ইসলামের পরিভাষায় যে যুগ অহী ও নবুয়াতি দিক-নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত বা নবুওয়তের শিক্ষা ও দাওয়াত পৌছেছে কিন্তু লোকেরা তা থেকে বিমুখ থেকেছে, তাকেও বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়াত। সেটা ষষ্ঠ শতকের দিগন্ত-বিস্তৃত বর্বর যুগ হোক বা ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যযুগীয় বর্বরতা হোক – সাধারণত অন্ধকার যুগ হিসাবে যাকে স্মরণ করা হয়। অথবা বিংশ শতাব্দীর দীপ্তিময় সভ্য ও অগ্রগতির যুগ হোক; আমরা যা অতিক্রম করছি। আল কুর’আনুল কারিমের ভাষায়, বিশ্বে আলোকরশ্মি একটিই এবং তার উৎস একটি।” [৫৪]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)



রেফারেন্সঃ
[৩৭] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (২০১৩), মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল? ঢাকা: দারুল কলম, পৃ. ১০০
[৩৮] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৩
[৩৯] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৯, ২০২
[৪০] প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৫
[৪১] প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৭
[৪২] প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৭
[৪৩] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫-২৪৬
[৪৪] প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬৮
[৪৫] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৭
[৪৬] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৬
[৪৭] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৫
[৪৮] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৫
[৪৯] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১৭
[৫০] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১৪
[৫১] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১২
[৫২] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯২
[৫৩] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৫
[৫৪] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (২০১০), রিসালাতে মুহাম্মাদি ও বর্তমান পশ্চিমা বিশ্ব, অনুবাদঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আঃ রহমান, ইসলামহাউজ.কম, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...