সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (8th Part)

পর্ব-৮

~সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের সাতটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা, জাহিলিয়াত, শারিয়া, জিহাদ, খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।



এই সিরিজের পর্ব-৩ এ জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তা সংক্ষিপ্তভাবে ইতিমধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। যেহেতু জাহিলিয়াতের ধারণাটি উস্তাদ মওদূদীর মতাদর্শ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেহেতু এই প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে বলে মনে করি। তাই সপ্তম পর্বে এই প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছি। আজকের পর্বে এর শেষাংশ দিচ্ছি। পরে যখন এই লেখাগুলি বই আকারে সংকলিত ও সম্পাদিত হবে তখন এই সংযোজনটুকু পর্ব-৩ এর প্রাসঙ্গিক অংশে যুক্ত করা হবে। এর পরের পর্বে নাদভীর জাহিলিয়াত ধারণাকে আরো কিছুটা বিস্তার করে নিতে চাই।


৯. পুনশ্চঃ উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত ধারণা প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ

মওদূদী – জাহিলিয়াত যে সমাজে বিরাজ করে সেখানে সামাজিক সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য মানুষই বিধি-বিধান তৈরি করে অন্য মানুষের উপরে তা আরোপ করে। এভাবে মানুষ নিজেই অন্য মানুষের আচরণ সুবিন্যস্ত করতে গিয়ে নিজেকে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষের আসনে আসীন করে ফেলে। এর ফলে মানুষের জাগতিক আচরণ যখন বিধি-বিধানকে অমান্য করে তখন তার বিচার ও ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করাও হয় জাগতিক আইন ও আদালতের মাধ্যমে। কারণ প্রতিটি কর্ম ও এর প্রতিফলকে দেখা হয় এই জগতের সীমানার মধ্যেই। পরজাগতিক বিচারের কোন বিবেচনাই এক্ষেত্রে করা হয় না। [১৩]

এই ধরণের সম্পূর্ণ জাগতিক এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যভিত্তিক মনোভাব, মওদূদীর মতে, এক বিশেষ আদলের সমাজ গড়ে তোলে। এই আদলের সমাজে যেসব ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে পারে কেবল তারাই নেতৃত্বের আসনগুলো লুফে নেয়। এর ফলে দুর্বল এবং ক্ষমতাহীনেরা এদেরকে মেনে চলতে বাধ্য হয়। মওদূদী বলেন সমাজ ম্যাকিয়াভেলীয় অনৈতিক পদ্ধতিতে শাসিত হয় যেখানে রাজনীতিতে ব্যক্তির নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে নির্মম ও নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বনে কুন্ঠা করা হয় না। [১৪] যেহেতু এই ধরণের সমাজ শুধু ব্যক্তিগত সুবিধার সর্বোচ্চ অর্জনকেই তার লক্ষ্য মনে করে সেহেতু তা সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হয়। বিস্ময়কর যে মওদূদী এই রকমের সমাজের মধ্যে কমিউনিস্ট সমাজকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন; কারণ তিনি মনে করতেন যে কমিউনিস্ট সমাজও আসলে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলেই লিপ্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেনঃ “sometimes even the proletarians [mazdūr] will erect their dictatorship by disruption” [১৫] তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে এই ধরণের সমাজের সবগুলিই সামাজিক ন্যায়বিচার (আদল) প্রতিষ্ঠায় কোন অবদান রাখে না; এবং এই জগতের প্রতি কোন রকমের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে নাঃ “The basic conduct of every individual in this society rests on the conviction [taṣawwur] that the world and all its wealth is a fully laden table [khwān-I yaghmā] and man is free to lay his hand on it at will [ḥasb-i manshāʾ] and whenever possible.” [১৬]

জীবনের অর্থ বা তাৎপর্য কি এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে “নির্ভেজাল অজ্ঞতা”ভিত্তিক এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়। এর ফলাফল বিচার করে মওদূদী এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে এই পদ্ধতি জীবনের সত্য বা হাকিকতের সঙ্গে সামঞ্জস্য সুনিশ্চিত করতে পারে না। [১৭] মওদূদী মনে করতেন যে জীবনকে ব্যাখ্যা করার যেসব পদ্ধতি ইন্দ্রিয়জ সংবেদ, কল্পনা এবং রূপক-প্রতীকভিত্তিক সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে মানবিক ভাবনাকে গঠন করে সেগুলি জীবনের মৌলিক তাৎপর্য অনুধাবন ও উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়। এগুলিকে তিনি দ্বিতীয় ধরণের জাহিলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই ধরণের পদ্ধতিগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম হিশেবে তিনি শিরককে চিহ্নিত করেছিলেন। শিরক হল অংশীদারিত্বভিত্তিক বহু-ঈশ্বরবাদ যা আল্লাহকে সর্বোচ্চ খোদা হিশেবে মেনে নেয় ঠিকই কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে আরো অন্যান্য নিম্নবর্গীয় খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস পোষণ করে। এর ফলে খোদার ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বে বিভাজন দেখা দেয়। [১৮] শিরকের এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে দেখা যায় যে মওদূদীর চিন্তাতে পূর্বেকার যুগের কর্তৃপক্ষ-স্বীকৃত মতের প্রতিফলন রয়েছে। তাদের মত করে তিনি মনে করতেন যে রাসুল স. এর মৃত্যুর সমকালেই একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুসলিমেরা পুনরায় মূর্তিপূজা ও শিরকে প্রত্যাবর্তন করেছিল। [১৯] হাম্বালি আলেমদের মত মওদূদী সুফিবাদ ও শিয়া মতবাদ সংশ্লিষ্ট জনপ্রিয় বিভিন্ন প্রথা ও প্রচলনকে বহু-ঈশ্বরবাদী শিরক বলে মনে করতেন। [২০]

এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি বাস্তব পরিস্থিতিকে উন্মোচিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে মওদূদী দক্ষিণ এশিয়াতে উনিশ শতকের শুরু থেকে চালু হয়ে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান একটি উত্তপ্ত বিতর্কে তার অবদান রাখতে পেরেছেন। এই বিতর্কের বিষয়বস্তু হল সুফি চর্চার কিছু রুসম রেওয়াজ নিয়ে; এইসব রুসম রেওয়াজ শরিয়তের আলোকে অনুমোদনযোগ্য কি না সেটিই হল এই চলমান বিতর্কের মর্ম। [২১] সুফিবাদের এই রুসম রেওয়াজগুলি মূলধারার শিয়া ইসলামের মধ্যেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। উদাহরণ হিশেবে বলা যায় নবী রাসুল ও তাদের পরিবারবর্গ ও অলি আউলিয়াসহ মৃত সম্মানিত মুসলিমদের মাজার জিয়ারতের কথা যা অনেকসময় সুস্পষ্ট মাজার পূজায় পরিণত হয়; অর্থাৎ এদেরকে উসিলা বানিয়ে বা সরাসরি এদের কাছে কোন কিছু চাওয়া বা মানত করা ইত্যাদি। মওদূদী তার পূর্বসূরি আলেমদের আকিদাগত ও ফিকহী যুক্তিবিন্যাসকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এইসব রুসম রেওয়াজের সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফল বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছিলেন। এই নিরীক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে এইসব রুসম রেওয়াজ “নির্ভেজাল অজ্ঞতা”র মতই নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনবে; অর্থাৎ মানুষের উপরে মানুষের কর্তৃত্ব কায়েম করবে।

এখানেও মওদূদীর যুক্তিবিন্যাস প্রচলিত ঐতিহ্যের গন্ডীর বাইরে চলে গিয়েছে বলেই প্রতীয়মান। এভাবে তিনি পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন মতাদর্শগুলিকেও তার বহু-ঈশ্বরবাদী শিরকের ধারণার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি তার অব্যবহিত পূর্বসূরি চিন্তক মুহাম্মদ আবদুহু এবং রশীদ রিদার কাছাকাছি ছিলেন বলা যায়। এদের অনুসরণ করে এই চিন্তাকে আরো অগ্রসর করে মওদূদী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে আধুনিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শগুলি যেমন জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ এবং শ্রেণী সংগ্রাম ইত্যাদিও হল শিরক। [২২] সংক্ষেপে বলতে গেলে মানুষের অসাম্য ভিত্তিক প্রতিটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণাই মওদূদীর শিরক ধারণার অন্তর্ভুক্ত।

মওদূদীর যুক্তিবিন্যাস যদিও এই পৃথিবীতে মানুষের স্ব-আরোপিত সার্বভৌমত্ব ধারণার ক্রিটিক হিশেবে আবর্তিত হয়েছে তবুও তিনি কখনোই ইহজগত থেকে পলায়নের কোন অবকাশ দেন নি। বৈরাগ্যবাদ অথবা সন্ন্যাসবাদ তার কাছে জাহিলিয়াতের আরেক নাম হিশেবে পরিগণিত ছিল। [২৩] ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিযুক্ত করে বলে তিনি এটিকেও মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর জুলুমের আরেকটি পন্থা বিবেচনা করতেন। [২৪]

মওদূদী সাধারণত ইসলামের ধর্মীয় ঐতিহ্যের বাইরে উৎপন্ন বিভিন্ন মতাদর্শগুলিকে তার জাহিলিয়াত ধারণার অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করে সমালোচনা করতেন। এর কারণ হল তিনি তার সমকালীন বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন আধুনিক আদর্শের বিকল্প হিশেবে একটি ইসলামী মতাদর্শ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সুফিবাদের সমালোচনা এই সাধারণ প্রবণতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম ছিল। তিনি যেহেতু প্রধানত পাশ্চাত্য আধুনিক মতাদর্শের মোকাবেলায় একটি বিকল্প মতাদর্শ বিনির্মাণে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন সেহেতু সুফিবাদের মত একটি অন্তর্মুখী ধার্মিকতা তার এই বিকল্প রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য খুব বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল না। [২৫] অন্যদিকে সুফিবাদ নিয়ে তার এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার সঙ্গে উলামাদের নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিনিধিদের বিতর্ক তৈরি হবার অন্যতম প্রধান একটি কারণ। তাবলীগ জামায়াতের সঙ্গে তার মতভিন্নতার পেছনেও তার এই দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। [২৬] প্রকৃত বিচারে বলতে গেলে সুফিবাদ ছিল মওদূদীর জন্য মতাদর্শিক বিতর্ক প্রক্ষেপণের একটি প্রধান ক্ষেত্র। এ কারণে আহমেদ মুকাররাম বলেছেন যে এই বিতর্ক হল ব্যক্তিগত হেদায়েত ও অনুশীলন-নির্ভর জ্ঞানকান্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী সামষ্টিক শাসন-নির্ভর জ্ঞানকান্ডের যে বিরোধ তার একটি প্রতীকী রুপ। [২৭]

মওদূদী তার দ্বিতীয় ধরণের জাহিলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় অনুষঙ্গ হিশেবে সর্বেশ্বরবাদী ও ঈশ্বরংশবাদী পদ্ধতিসমূহের যে সমালোচনা করেছেন তা-ও তার সুফিবাদ সম্পর্কিত বিরূপ ধারণার সঙ্গেই সম্পর্কিত। সুফিবাদকে মওদূদী যেভাবে বুঝেছিলেন তা হল এই রকম – কোন অস্তিত্বই আল্লাহর বাইরে অস্তিত্বমান নয় অর্থাৎ কোন অস্তিত্বই তার নিজ সত্তা থেকে উৎপন্ন হয় নি, সব অস্তিত্ব প্রকৃত বিচারে এক আল্লাহর সৃষ্টি; এর অর্থ হল “all existing things [tamām mawjūdāt] are the outer manifestations of the one being [ek hī wujūd kā ẓuhūr-i khārijī], only this being exists, everything else does not”. [২৮] এই বিশ্বাস, মওদূদী যুক্তি প্রয়োগ করে বলেছেন, মানুষকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাহীন করে তোলে এবং তাকে স্রষ্টার একটি পাপেট বা পুতুলে পরিণত করে। ফলতঃ মানুষ তার উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং অক্রিয় ও অজ্ঞ হয়ে পড়ে; এবং সে অবাধে কেবলমাত্র তার ব্যক্তিগত আসক্তি পূরণে নিয়োজিত হয়ে যায়; তার এই কর্মকান্ড তার জন্য কি পরিণতি বয়ে আনতে পারে তার সেই বিবেচনাবোধ হারিয়ে যায়। [২৯]

এই বিশ্লেষণের আলোকে মওদূদী সিদ্ধান্ত নেন যে উল্লেখিত দুটি পদ্ধতির কোনোটিই জীবনের মৌলিক প্রশ্নাবলীর সন্তোষজনক উত্তর দেবার জন্য উপযুক্ত নয়। এ পর্যন্ত পর্যালোচিত সব পদ্ধতিই, তিনি বলেন, অজ্ঞতার উপরে গড়ে উঠেছে, ইলমের উপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি; এ কারণে এদের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিণতি হবার কথা তা-ই হয়েছে। একটি অচেনা ও অজানা বিশ্বের মুখোমুখি হয়ে, মওদূদী মত প্রকাশ করেন, মানুষ হয়ত একটি অজ্ঞতা এবং বিহ্বলতার পরিবেশে নিজেকে আবিস্কার করেছিল; এবং সে কারণে যা তার ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছিল তাকেই সত্য বা বাস্তব বলে মেনে নিয়েছিল। [৩০] কিন্তু এর নেতিবাচক পরিণতি যা হয়েছিল তার ফলে মানুষকে শেষপর্যন্ত এর একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প হিশেবে নবী রাসুলদের বাণীকেই গ্রহণ করতে হয়েছে। কারণ এই বাণীতেই রয়েছে সত্য বা হাকিকতের প্রকৃত ব্যাখ্যা। এই বাণী, যা ইসলামী পথ বা তরিকা বলে পরিচিত তাই, মওদূদীর মতে, একটি বৈজ্ঞানিক পথ যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সঙ্গতিপূর্ণ উপায়ে জীবনের যাবতীয় মৌলিক প্রশ্নাবলীর সদুত্তর দিতে সক্ষমঃ “Whenever you are confronted with such a situation [ṣurat-i ḥāl] your first endeavour is to search for a person who claims to know a solution. Then, on the basis of circumstantial evidence [qarāʾin se], you seek to satisfy yourself regarding whether or not such a person is trustworthy [qābil-i iʿtimād]. Then you go ahead under this guidance. When it is proven by experience [tajriba se thābit ho jātā he] that the information he provided has not led to any negative result whilst you acted on it, then you are convinced that this person possessed the requisite knowledge and that this information [maʿlūmāt] supplied by him […] was sound [ṣaḥīḥ]. This is a scientific way, and if there is not any other scientific way, then this must be the only correct one for formulating one’s viewpoint [rāʾy].” [৩১]

এখান থেকে বোঝা যায় যে মওদূদী তার সমকালীন পশ্চিমা বিজ্ঞানের জয়জয়কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার ভাষ্যকৃত ইসলামকে একটি বিজ্ঞানসম্মত ইসলাম হিশেবে উপস্থাপন করেছিলেন। এদিক থেকে মওদূদীকে নিঃসন্দেহে তার সময়ের সন্তান হিশেবে গণ্য করা যায়।

মওদূদী ইসলামকে একটি সর্বগামী পথ হিশেবে বুঝেছিলেন। কাজেই এই ইসলাম কখনোই জাহিলিয়াতের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে না। এ কারণে তিনি এক পর্যায়ে ১৯৩০ দশকের শেষের দিকে ও ১৯৪০ দশকের প্রথম দিকে তার জাহিলিয়াত ধারণাটির মধ্যে ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা কুফরকেও অন্তর্ভুক্ত করেনঃ “Unbelief means refusal to obey God; Islam means […] refusal to accept any path, law [qānūn] or order which stands against the guidance sent down from God.” [৩২] এই অনুষঙ্গে তিনি আরো লেখেনঃ “One way to reach a decision in every eventuality has been laid down in the Book of God and in the Sunna of His Messenger other ways are prompted by the desires of your lower self [nafs kī khwāhishāt], by the ways of your ancestors, or by man-made laws. If one discharges the way that God has laid down and decides for some other way, then he basically chooses the path of unbelief. If one had chosen this manner for every aspect of his life then he is a complete unbeliever [kāfir].” [৩৩]

মওদূদী এখানে যেভাবে জাহিলিয়াত ও কুফরকে একাকার করে দিয়েছেন তা ভবিষ্যতের জন্য একটি নেতিবাচক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে রেখেছিল। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবিকই পরবর্তীকালে আরব বিশ্বে তার অতি উৎসাহী অনুসারীরা তাদের মত করে ব্যবহার করেছে। [৩৪] এ থেকে এটাও বোঝা যায় যে কুফরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সূত্রে মওদূদীর জাহিলিয়াত প্রত্যয়টির একটি আইনগত দিকও রয়েছে; এ থেকে যে অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় সেটা হল এই যে মওদূদী ইসলামকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন সেভাবে ইসলাম অনেকগুলো বিকল্পের মধ্যে কেবলমাত্র একটি বিকল্প নয়, কিংবা অনেক বিকল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিকল্পও নয়, বরঞ্চ এটিই একমাত্র বৈধ বিকল্প বা সত্য। কাজেই এটা প্রমাণ করে যে মওদূদীর কাছে জাহিলিয়াত হল এমন একটি বর্গীয় (categorical) প্রত্যয় যা সম্পূর্ণভাবে ইসলামের বিপ্রতীপ। অন্যকথায় জাহিলিয়াত অহিভিত্তিক শরিয়াতের আইন অমান্য করার শামিল।

আমরা আগেই জেনেছি যে জাহিলিয়াত ইসলামের সঙ্গে একইসঙ্গে একইসময়ে বিরাজ করতে পারে; এজন্য ইসলামের ধ্রুপদী যুগের মুফাসসির আল-বায়যাভি একথার উপরে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে জাহিলিয়াতের ছায়া বা অবশেষ (আমরু জাহিলিয়া) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে থেকে গিয়েছিল। [৩৫] মওদূদীর মতে মানুষের আকলী ক্ষমতাই তাকে নৈতিক শ্রেয়পথ হিশেবে ঐশী হেদায়েতের পথকে বেছে নিতে সহায়তা করে; আর এই পথেই রয়েছে তার জন্য জীবনের যাবতীয় মৌলিক প্রশ্নাবলীর সন্তোষজনক উত্তর। তিনি বলেছেন মানুষকে এই পথে আহবান করার জন্যে যাদেরকে আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন তারা হলেন নবী রাসুল। মওদূদী ইসলামের প্রতিকল্প হিশেবে যে জাহিলিয়াতের প্রত্যয় প্রস্তাব করেছেন সেখানে এজন্যেই নবী রাসুলদের এত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। [৩৬] নবী রাসুলেরা শুধু আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন নি তারা এই বাণীর ব্যাখ্যা করে একে স্বীকৃত কর্তৃত্ব হিশেবে অধিষ্ঠিত করেছেন।



রেফারেন্সঃ[১৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৩
[১৪] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৭; দেখুন Machiavelli, Nicolò (1979). Il Principe (De principatibus), Richardson, Brian (ed.), Manchester: MUB., pp. 47–9.
[১৫] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৮
[১৬] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৯
[১৭] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩০-
[১৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৮-
[১৯] al-Ṭabarī, Muḥammad ibn Jarīr (1426/2005), Taʾʾrīkh al-Ṭabarī: taʾrīkh al-umam wa’l-mulūk, al-Jarrāḥ, Nawāf (ed.). 6 vols., Beirut: Dār Ṣādir. II: pp. 530–59.
[২০] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৯
[২১] This debate owed to a considerable extent to the activities of the so-called Ṭarīqa-yi muḥammadiyya around Sayyid Aḥmad Barelwī and Shāh Ismāʿīl Dihlawī (both killed 1246/1831). Their views on the matter, heavily resembling Wahhābī positions, have been enshrined in their Ṣirāṭ al-mustaqīm and Taqwiyyat al-īmān. See, for example, Hartung, Jan-Peter (2004b), Viele Wege und ein Ziel. Leben und Werk von Sayyid Abū l-Ḥasan ʿAlī al-Ḥasanī Nadwī (1914–1999), Würzburg: Ergon. pp. 108–17; Hartung, Jan-Peter (2008), ‘Wahhābīs and Anti-Wahhābīs: The Learned Discourse on Sufism in Contemporary South Asia’, in: Lassen, Søren Christian and Hugh van Skyhawk (eds). Sufi Traditions and New Departures. Recent Scholarship on Continuity and Change in South Asian Sufism, Islamabad: Taxila Institute of Asian Civilizations, pp. 82–110; Riexinger, Martin (2004). Sanāʾullāh Amritsarī (1868–1948) und die Ahl-i-Ḥadīs [sic] im Punjab unter britischer Herrschaft, Würzburg: Ergon, pp. 238–68.
[২২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ২২
[২৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, অধ্যায় বি-১
[২৪] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ২৩-২৫
[২৫] Besides Sufism, Mawdūdī named ‘Neo-Platonism, Yoga, […] Christian monasticism, Buddhism, and so on’ (ibid., p. 23) as examples of monasticism.
[২৬] See, for example, Zakariyyā, Muḥammad (1983). Fitna-yi mawdūdiyyat yā jamāʿat-i islāmī ek lamḥa-yi fikriyya, Sahāranpūr: Kutubkhāna-yi ishāʿat al-ʿulūm.; Nuʿmānī, Muḥammad Manẓūr (1998). Mawlānā Mawdūdī ke sāth merī rafāqat kī sar-guzasht awr ab merā mawqif!, Lucknow: al-Furqān Buk d′ipo. Nadwī, Abū ’l-Ḥasan ʿAlī (1400/1980). Madhhab wa tamaddun, Lucknow: Majlis-i taḥqīqāt wa nashriyyāt-i islām.; Nadwī, Abū ’l-Ḥasan ʿAlī (1400/1980) ʿAṣr-i ḥāḍir meṇ dīn kī tafhīm wa tashrīḥ, Lucknow: Majlis-i taḥqīqāt wa nashriyyāt-i islām.; Nadwī, Abū ’l-Ḥasan ʿAlī (1418/1997), Manṣib-i nubuwwat awr uske ʿālá maqām-i ḥāmilīn, Lucknow: Majlis-i taḥqīqāt wa nashriyyāt-i islām
[২৭] For this terminology, see Mukarram, Ahmed (1992). Some Aspects of Contemporary Islamic Thought;Guidance and Governance in the Work of Mawlana Abul Hasan Ali Nadwi and Mawlana Abul Aala Mawdudi [sic], unpublished PhD dissertation, University of Oxford., pp. 9–11 et passim.
[২৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩৭
[২৯] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩৮-
[৩০] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৪০
[৩১] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩০-
[৩২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৭২), খুতবাত – ইসলাম কে বুনিয়াদি আরকান কি এহমিয়াত ওয়া জরুরাত পার দিলনাশিন আওর আসান-আন্দাজ মেঁ ইয়াকিন আফ্রে দালায়েল, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ৮১
[৩৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৭২), খুতবাত – ইসলাম কে বুনিয়াদি আরকান কি এহমিয়াত ওয়া জরুরাত পার দিলনাশিন আওর আসান-আন্দাজ মেঁ ইয়াকিন আফ্রে দালায়েল, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ৮২
[৩৪] Nedza, Justyna (2008). Das takfīr-Konzept im Wandel? Erklärungsversuch zueiner Kategorie heutigen islamistischen Denkens, unpublished MA dissertation, Ruhr-Universität Bochum, pp. 74–97.
[৩৫] al-Bayḍāwī, ʿAbdallāh ibn ʿUmar (1330h). Anwār al-tanzīl wa-asrār al-taʾʾwīl, 5 vols., Cairo: Dār al-kutub al-ʿarabiyya al-kubrá., IV: pp. 162f.
[৩৬] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ৩০-৩৩

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...