সোমবার, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (9th Part)

পর্ব-৯

~সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~


বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের সাতটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা, জাহিলিয়াত, শারিয়া, জিহাদ, খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।




এই সিরিজের পর্ব-৩ এ জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তা সংক্ষিপ্তভাবে ইতিমধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। জাহিলিয়াতের ধারণা যেহেতু উস্তাদ মওদূদীর মতাদর্শ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেহেতু পর্ব-৭ ও ৮-এ এই ধারণা প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপিত হয়েছে। আজকের পর্বে জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে মওলানা নাদভীর ধারণার আরো বিস্তার করা হচ্ছে। পরে বই হিশেবে যখন এই লেখাগুলি সংকলিত ও সম্পাদিত হবে তখন এই সংযোজনাগুলো পর্ব-৩ এর প্রাসঙ্গিক অংশে যুক্ত হবে।

১০. পুনশ্চঃ মওলানা নাদভীর জাহিলিয়াত ধারণা প্রসঙ্গে আরো তথ্য ও বিশ্লেষণ
নাদভী – ইসলাম-পূর্ব জাহিলিয়াতকে নাদভীও খুঁটিনাটি অনুষঙ্গসহ বর্ণনা করেছিলেন। এ কাজ তিনি তার ইতিহাস বিষয়ক রচনায় যেমন করেছেন তেমনি আকিদা, ঈমান ও ইসলামের রোকন বিষয়ক রচনাতেও করেছেন। আসলে খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে ইসলামের বৈপ্লবিক আগমন ও ভূমিকা পর্যাপ্তভাবে পরিস্ফুট হয় তখনই যখন তা প্রাক-ইসলামী যুগের জাহিলিয়াতের বিপরীতে উপস্থাপিত হয়। নাদভী ইসলামের অন্য সকল ইতিহাসবিদের মতই এই রীতি অনুসরণ করেছেন। তার ‘মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল?’ গ্রন্থটির বিষয় বিন্যাসকে বিশ্লেষণ করলেই এটি পরিস্কার বোঝা যায়। সেখানে তিনি ইসলামের আবির্ভাবের প্রেক্ষাপট পরিস্ফুট করার জন্য প্রাক-ইসলামী আরব জাহিলিয়াতের প্রতিটি খুঁটিনাটি অনুষঙ্গসহ উপস্থাপন করেছেন। এভাবে তার ইতিহাস কাঠামোতে জাহিলিয়াত ও ইসলাম একটি অসম ও বিপ্রতীপ প্রত্যয়-যুগল হিশেবে বর্ণিত হয়েছে। এই প্রত্যয়-যুগলের পারস্পরিক সম্পর্ক যে হক ও বাতিলের দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের আরেকটি প্রকাশ সেটি তার উপস্থাপনায় স্ফটিকস্বচ্ছ হয়ে উঠেছে। এই দ্বন্দ্ব ও দ্বৈরথ যে ইতিহাসের একটি চলমান প্রক্রিয়া সেটিও তিনি তার বিষয় বিন্যাস ও বিশ্লেষণে বারবার উন্মোচিত করেছেন। জাহিলিয়াত তার ইতিহাস দর্শনে অন্ধকার বা অমানিশার প্রতীক ও যুগ হিশেবে পরিগণিত হয়েছে। এই জাহিলিয়াত বা অন্ধকার ভেদ করে ইসলামের আগমন একটি নতুন আলো ও যুগের বার্তা বহন করেছিল খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে। তৎকালীন পারস্য ও বৈজন্তীয় সভ্যতাকেও তিনি সদ্য আবির্ভূত ইসলামের বিপরীত হিশেবে এই জাহিলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত করে দেখিয়েছেন।

তিনি জাহিলিয়াত যুগের আরবদের সম্পর্কে লিখেছেনঃ “...একসময় তারা ভীষণভাবে ধর্মীয় ও নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়েছিলো। কারণ একদিকে তারা নবুওয়তের আসমানি শিক্ষা থেকে অনেক দূরে ছিলো, অন্যদিকে জগত-সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় বহু শতাব্দী যাবত এক আরব উপদ্বীপেই আবদ্ধ ছিলো। তদুপরি তারা বাপ-দাদার ধর্ম এবং জাতীয় আচার-প্রথা ও কুসংস্কারকেই যুগ যুগ ধরে আঁকড়ে ধরেছিলো।

খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকে তারা অবক্ষয় ও অধঃপতনের এমন চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছিলো, যার নযির সমসাময়িক পৃথিবীতে খুব একটা ছিলো না। মূর্তিপূজা তার যাবতীয় বীভৎসরূপ নিয়ে শিকড় গেড়ে বসেছিলো। বিভিন্ন নৈতিক ও সামাজিক ব্যাধি তাদেরকে ভিতর থেকে খোকলা করে ফেলেছিলো। এক কথায় বলতে হলে বলা যায়, আসমানি ধর্মের অধিকাংশ গুণ-বৈশিষ্ট্য ও সৌন্দর্য-মহিমা থেকেই তারা বঞ্চিত ছিলো, আবার জাহেলিয়াতের নিকৃষ্টতম দোষ-ব্যাধিগুলো তাদের মাঝে পূর্ণ মাত্রায় বিদ্যমান ছিলো। পুরো আরব জাযিরাতে আলো বলতে কিছুই ছিলো না, ছিলো শুধু ঘোর অন্ধকার।” [৩৭]

এরপরে তিনি ইসলামের অগ্রযাত্রাকে বর্ণনা করেছেন ‘জাহেলিয়াতের অন্ধকার থেকে ইসলামের আলোতে’ [৩৮] ধাবমান হিশেবে। এভাবে এই যাত্রা তৈরি করেছিল ‘জাহেলিয়াতের কাঁচামাল থেকে মানবতার শ্রেষ্ঠ সম্পদ’, ‘নতুন ব্যক্তি, নতুন সমাজ’ ও ‘ভারসাম্যপূর্ণ মানবগোষ্ঠী’। [৩৯]। এই যুগকে তিনি বলেছেন ‘ইসলামের সোনালী যুগ’ [৪০] ও ‘মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বের যুগ’ [৪১]। কারণ ‘খেলাফতে রাশেদাই হল সর্বোত্তম আদর্শ’ [৪২]।

এরপরে জাহিলিয়াতের ভাবধারার যতই প্রত্যাবর্তন হয়েছে ততই মুসলিম উম্মাহর অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়েছে। নাদভী লিখেছেনঃ “...অনেকেই জাহেলিয়াতের চিন্তা চেতনা ও রোগজীবাণু বহন করতো। ফলে স্বভাবতই জীবন ও সমাজের সর্বত্র তা সংক্রমিত হয়ে পড়েছিলো এবং মানুষ তাদের স্বভাব-চরিত্র ও নীতি-নৈতিকতাকেই অনুসরণ করতে শুরু করেছিলো। ... ...ফলে ইসলামি সমাজ ও মুসলিম জীবনে জাহেলিয়াত আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো এবং দ্রুত শক্তি বিস্তার করতে লাগলো।” [৪৩]

এ কারণে মুসলিম বিশ্বব্যাপী আবার স্থবিরতা দেখা দেয় এবং এই শূন্যতার পরিসরে আধুনিক শিল্প ও জ্ঞান-বিজ্ঞানে ইউরোপের উত্থান ঘটে। তিনি জাহিলিয়াত ধারণার মাধ্যমেই মুসলিম উম্মাহর এই পতনকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন এবং এর ফলে বিশ্বের কি ক্ষতি হল তা নিরূপণ করেছেন। সমান্তরালভাবে আধুনিক পাশ্চাত্য সভ্যতার স্বভাব ও প্রকৃতির উন্মোচন ও বিশদ বর্ণনাও তিনি করেছেন। এভাবে তিনি পাশ্চাত্যের উত্থানকে বস্তুবাদ, ধর্মহীনতা, জাতিবাদী সংঘাত, ভোগবাদ ইত্যাদি হিশেবে দেখেছেন এবং এসব কিভাবে ‘উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের নির্লজ্জ প্রতিযোগিতা’র [৪৪] মধ্য দিয়ে ‘মানবতার আত্মিক বিপর্যয়’ [৪৫] বয়ে এনেছে তিনি তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা করেছেন। ‘সমগ্র বিশ্বের জাহেলিয়াতমুখিতা’ [৪৬] থেকে ফেরত আসার জন্য তিনি ‘বিশ্বনেতৃত্বের আসনে ইসলামের প্রত্যাবর্তন’ [৪৭] হোক সেই আকাঙ্খা উতসাহভরে ব্যক্ত করেছেন। ‘মুসলিম বিশ্বের নব-উত্থান’ [৪৮] কামনায় তিনি ‘শিক্ষা-ব্যবস্থায় নতুন বিন্যাস’ [৪৯], ‘জ্ঞান-গবেষণায় নেতৃত্ব পুনরুদ্ধার’ [৫০], ‘শিল্প, প্রযুক্তি ও সমরযোগ্যতা’ [৫১] এবং ‘নতুন ঈমান ও আত্মিক প্রস্তুতি’ [৫২] গ্রহণের জন্য ‘আরববিশ্বের কাছে ইসলামী বিশ্বের প্রত্যাশা’ [৫৩] উন্মুখভাবে ব্যক্ত করেছেন।


তাহলে দেখা যাচ্ছে যে উস্তাদ মওদূদীর মত মওলানা নাদভীও জাহিলিয়াতকে একটি স্থান-কাল নিরপেক্ষ প্রত্যয় হিশেবে বুঝেছেন। একারণে জাহিলিয়াত প্রত্যয়ের সাহায্যে তিনি ইসলামের যে পুর্ণাঙ্গ ইতিহাস রচনা করেছেন সেখানে প্রাক-ইসলামী জাহিলিয়াত এবং আধুনিক জাহিলিয়াত এই দুই জাহিলিয়াতেরই অবতারণা তিনি করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “আমাদের সামনে যখন আইয়ামে জাহেলিয়াত বা অন্ধকার যুগের নাম আসে তখন চখের সামনে ভেসে উঠে খৃস্টীয় ষষ্ঠ শতকের সেই তমসাচ্ছন্ন যুগ। যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ও্যা সাল্লাম। বিকশিত হয়েছিল তা৬র হিদায়েত ও প্রশিক্ষণ। বিশ্ববাসী দেখেছিল তাঁর মুজিযা। জাহেলিয়াত শব্দটি কানে আসলেই ভেসে উঠে চোখের সামনে আরব জাতি, তাদের বর্বতা, লাগামহীন চলাফেরার দৃশ্য। ঐতিহাসিকগণ যার চিত্র তুলে ধরেছেন তাদের গ্রন্থে।

তবে জাহেলিয়াত বা মূর্খতা শুধু সে কালের সাথে বিশেষিত নয়, ইসলামের পরিভাষায় যে যুগ অহী ও নবুয়াতি দিক-নির্দেশনা থেকে বঞ্চিত বা নবুওয়তের শিক্ষা ও দাওয়াত পৌছেছে কিন্তু লোকেরা তা থেকে বিমুখ থেকেছে, তাকেও বলা হয় আইয়ামে জাহেলিয়াত। সেটা ষষ্ঠ শতকের দিগন্ত-বিস্তৃত বর্বর যুগ হোক বা ইউরোপীয় ইতিহাসের মধ্যযুগীয় বর্বরতা হোক – সাধারণত অন্ধকার যুগ হিসাবে যাকে স্মরণ করা হয়। অথবা বিংশ শতাব্দীর দীপ্তিময় সভ্য ও অগ্রগতির যুগ হোক; আমরা যা অতিক্রম করছি। আল কুর’আনুল কারিমের ভাষায়, বিশ্বে আলোকরশ্মি একটিই এবং তার উৎস একটি।” [৫৪]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)



রেফারেন্সঃ
[৩৭] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (২০১৩), মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হল? ঢাকা: দারুল কলম, পৃ. ১০০
[৩৮] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৫৩
[৩৯] প্রাগুক্ত, পৃ. ১৯৯, ২০২
[৪০] প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৫
[৪১] প্রাগুক্ত, পৃ. ২০৭
[৪২] প্রাগুক্ত, পৃ. ২১৭
[৪৩] প্রাগুক্ত, পৃ. ২৪৫-২৪৬
[৪৪] প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৬৮
[৪৫] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪০৭
[৪৬] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৬
[৪৭] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৫
[৪৮] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৬৫
[৪৯] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১৭
[৫০] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১৪
[৫১] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫১২
[৫২] প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯২
[৫৩] প্রাগুক্ত, পৃ. ৫৪৫
[৫৪] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (২০১০), রিসালাতে মুহাম্মাদি ও বর্তমান পশ্চিমা বিশ্ব, অনুবাদঃ আব্দুল্লাহ শহীদ আঃ রহমান, ইসলামহাউজ.কম, ১৮ নভেম্বর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (8th Part)

পর্ব-৮

~সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের সাতটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা, জাহিলিয়াত, শারিয়া, জিহাদ, খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।



এই সিরিজের পর্ব-৩ এ জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তা সংক্ষিপ্তভাবে ইতিমধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। যেহেতু জাহিলিয়াতের ধারণাটি উস্তাদ মওদূদীর মতাদর্শ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেহেতু এই প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে বলে মনে করি। তাই সপ্তম পর্বে এই প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেছি। আজকের পর্বে এর শেষাংশ দিচ্ছি। পরে যখন এই লেখাগুলি বই আকারে সংকলিত ও সম্পাদিত হবে তখন এই সংযোজনটুকু পর্ব-৩ এর প্রাসঙ্গিক অংশে যুক্ত করা হবে। এর পরের পর্বে নাদভীর জাহিলিয়াত ধারণাকে আরো কিছুটা বিস্তার করে নিতে চাই।


৯. পুনশ্চঃ উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত ধারণা প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ

মওদূদী – জাহিলিয়াত যে সমাজে বিরাজ করে সেখানে সামাজিক সহাবস্থান নিশ্চিত করার জন্য মানুষই বিধি-বিধান তৈরি করে অন্য মানুষের উপরে তা আরোপ করে। এভাবে মানুষ নিজেই অন্য মানুষের আচরণ সুবিন্যস্ত করতে গিয়ে নিজেকে চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষের আসনে আসীন করে ফেলে। এর ফলে মানুষের জাগতিক আচরণ যখন বিধি-বিধানকে অমান্য করে তখন তার বিচার ও ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করাও হয় জাগতিক আইন ও আদালতের মাধ্যমে। কারণ প্রতিটি কর্ম ও এর প্রতিফলকে দেখা হয় এই জগতের সীমানার মধ্যেই। পরজাগতিক বিচারের কোন বিবেচনাই এক্ষেত্রে করা হয় না। [১৩]

এই ধরণের সম্পূর্ণ জাগতিক এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যভিত্তিক মনোভাব, মওদূদীর মতে, এক বিশেষ আদলের সমাজ গড়ে তোলে। এই আদলের সমাজে যেসব ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ স্বার্থ হাসিল করতে পারে কেবল তারাই নেতৃত্বের আসনগুলো লুফে নেয়। এর ফলে দুর্বল এবং ক্ষমতাহীনেরা এদেরকে মেনে চলতে বাধ্য হয়। মওদূদী বলেন সমাজ ম্যাকিয়াভেলীয় অনৈতিক পদ্ধতিতে শাসিত হয় যেখানে রাজনীতিতে ব্যক্তির নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলে নির্মম ও নিষ্ঠুর পন্থা অবলম্বনে কুন্ঠা করা হয় না। [১৪] যেহেতু এই ধরণের সমাজ শুধু ব্যক্তিগত সুবিধার সর্বোচ্চ অর্জনকেই তার লক্ষ্য মনে করে সেহেতু তা সামন্ততান্ত্রিক ও পুঁজিতান্ত্রিক সমাজে পরিণত হয়। বিস্ময়কর যে মওদূদী এই রকমের সমাজের মধ্যে কমিউনিস্ট সমাজকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন; কারণ তিনি মনে করতেন যে কমিউনিস্ট সমাজও আসলে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলেই লিপ্ত ছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেনঃ “sometimes even the proletarians [mazdūr] will erect their dictatorship by disruption” [১৫] তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে এই ধরণের সমাজের সবগুলিই সামাজিক ন্যায়বিচার (আদল) প্রতিষ্ঠায় কোন অবদান রাখে না; এবং এই জগতের প্রতি কোন রকমের দায়িত্ববোধ জাগ্রত করে নাঃ “The basic conduct of every individual in this society rests on the conviction [taṣawwur] that the world and all its wealth is a fully laden table [khwān-I yaghmā] and man is free to lay his hand on it at will [ḥasb-i manshāʾ] and whenever possible.” [১৬]

জীবনের অর্থ বা তাৎপর্য কি এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিতে “নির্ভেজাল অজ্ঞতা”ভিত্তিক এই পদ্ধতি ব্যর্থ হয়। এর ফলাফল বিচার করে মওদূদী এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে এই পদ্ধতি জীবনের সত্য বা হাকিকতের সঙ্গে সামঞ্জস্য সুনিশ্চিত করতে পারে না। [১৭] মওদূদী মনে করতেন যে জীবনকে ব্যাখ্যা করার যেসব পদ্ধতি ইন্দ্রিয়জ সংবেদ, কল্পনা এবং রূপক-প্রতীকভিত্তিক সামঞ্জস্য বিধানের মাধ্যমে মানবিক ভাবনাকে গঠন করে সেগুলি জীবনের মৌলিক তাৎপর্য অনুধাবন ও উপস্থাপনে ব্যর্থ হয়। এগুলিকে তিনি দ্বিতীয় ধরণের জাহিলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। এই ধরণের পদ্ধতিগুলির মধ্যে সর্বপ্রথম হিশেবে তিনি শিরককে চিহ্নিত করেছিলেন। শিরক হল অংশীদারিত্বভিত্তিক বহু-ঈশ্বরবাদ যা আল্লাহকে সর্বোচ্চ খোদা হিশেবে মেনে নেয় ঠিকই কিন্তু আল্লাহর সঙ্গে আরো অন্যান্য নিম্নবর্গীয় খোদার অস্তিত্বে বিশ্বাস পোষণ করে। এর ফলে খোদার ক্ষমতা ও সার্বভৌমত্বে বিভাজন দেখা দেয়। [১৮] শিরকের এই সংজ্ঞার ভিত্তিতে দেখা যায় যে মওদূদীর চিন্তাতে পূর্বেকার যুগের কর্তৃপক্ষ-স্বীকৃত মতের প্রতিফলন রয়েছে। তাদের মত করে তিনি মনে করতেন যে রাসুল স. এর মৃত্যুর সমকালেই একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুসলিমেরা পুনরায় মূর্তিপূজা ও শিরকে প্রত্যাবর্তন করেছিল। [১৯] হাম্বালি আলেমদের মত মওদূদী সুফিবাদ ও শিয়া মতবাদ সংশ্লিষ্ট জনপ্রিয় বিভিন্ন প্রথা ও প্রচলনকে বহু-ঈশ্বরবাদী শিরক বলে মনে করতেন। [২০]

এই বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি দক্ষিণ এশিয়ার একটি বাস্তব পরিস্থিতিকে উন্মোচিত করেছে। এর মধ্য দিয়ে মওদূদী দক্ষিণ এশিয়াতে উনিশ শতকের শুরু থেকে চালু হয়ে আজ পর্যন্ত বিদ্যমান একটি উত্তপ্ত বিতর্কে তার অবদান রাখতে পেরেছেন। এই বিতর্কের বিষয়বস্তু হল সুফি চর্চার কিছু রুসম রেওয়াজ নিয়ে; এইসব রুসম রেওয়াজ শরিয়তের আলোকে অনুমোদনযোগ্য কি না সেটিই হল এই চলমান বিতর্কের মর্ম। [২১] সুফিবাদের এই রুসম রেওয়াজগুলি মূলধারার শিয়া ইসলামের মধ্যেও ব্যাপকভাবে প্রচলিত। উদাহরণ হিশেবে বলা যায় নবী রাসুল ও তাদের পরিবারবর্গ ও অলি আউলিয়াসহ মৃত সম্মানিত মুসলিমদের মাজার জিয়ারতের কথা যা অনেকসময় সুস্পষ্ট মাজার পূজায় পরিণত হয়; অর্থাৎ এদেরকে উসিলা বানিয়ে বা সরাসরি এদের কাছে কোন কিছু চাওয়া বা মানত করা ইত্যাদি। মওদূদী তার পূর্বসূরি আলেমদের আকিদাগত ও ফিকহী যুক্তিবিন্যাসকে আরো এগিয়ে নিয়ে গিয়ে এইসব রুসম রেওয়াজের সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফল বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেছিলেন। এই নিরীক্ষণের ভিত্তিতে তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে এইসব রুসম রেওয়াজ “নির্ভেজাল অজ্ঞতা”র মতই নেতিবাচক পরিণতি বয়ে আনবে; অর্থাৎ মানুষের উপরে মানুষের কর্তৃত্ব কায়েম করবে।

এখানেও মওদূদীর যুক্তিবিন্যাস প্রচলিত ঐতিহ্যের গন্ডীর বাইরে চলে গিয়েছে বলেই প্রতীয়মান। এভাবে তিনি পাশ্চাত্য ধ্যানধারণা থেকে উৎপন্ন বিভিন্ন মতাদর্শগুলিকেও তার বহু-ঈশ্বরবাদী শিরকের ধারণার অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি তার অব্যবহিত পূর্বসূরি চিন্তক মুহাম্মদ আবদুহু এবং রশীদ রিদার কাছাকাছি ছিলেন বলা যায়। এদের অনুসরণ করে এই চিন্তাকে আরো অগ্রসর করে মওদূদী এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে আধুনিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আদর্শগুলি যেমন জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ এবং শ্রেণী সংগ্রাম ইত্যাদিও হল শিরক। [২২] সংক্ষেপে বলতে গেলে মানুষের অসাম্য ভিত্তিক প্রতিটি সামাজিক ও রাজনৈতিক ধারণাই মওদূদীর শিরক ধারণার অন্তর্ভুক্ত।

মওদূদীর যুক্তিবিন্যাস যদিও এই পৃথিবীতে মানুষের স্ব-আরোপিত সার্বভৌমত্ব ধারণার ক্রিটিক হিশেবে আবর্তিত হয়েছে তবুও তিনি কখনোই ইহজগত থেকে পলায়নের কোন অবকাশ দেন নি। বৈরাগ্যবাদ অথবা সন্ন্যাসবাদ তার কাছে জাহিলিয়াতের আরেক নাম হিশেবে পরিগণিত ছিল। [২৩] ব্যাক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ব্যক্তিকে সমাজ থেকে বিযুক্ত করে বলে তিনি এটিকেও মানুষ কর্তৃক মানুষের উপর জুলুমের আরেকটি পন্থা বিবেচনা করতেন। [২৪]

মওদূদী সাধারণত ইসলামের ধর্মীয় ঐতিহ্যের বাইরে উৎপন্ন বিভিন্ন মতাদর্শগুলিকে তার জাহিলিয়াত ধারণার অন্তর্ভুক্ত বিবেচনা করে সমালোচনা করতেন। এর কারণ হল তিনি তার সমকালীন বিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন আধুনিক আদর্শের বিকল্প হিশেবে একটি ইসলামী মতাদর্শ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সুফিবাদের সমালোচনা এই সাধারণ প্রবণতার একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম ছিল। তিনি যেহেতু প্রধানত পাশ্চাত্য আধুনিক মতাদর্শের মোকাবেলায় একটি বিকল্প মতাদর্শ বিনির্মাণে নিজেকে নিয়োগ করেছিলেন সেহেতু সুফিবাদের মত একটি অন্তর্মুখী ধার্মিকতা তার এই বিকল্প রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য খুব বেশি প্রাসঙ্গিক ছিল না। [২৫] অন্যদিকে সুফিবাদ নিয়ে তার এই দৃষ্টিভঙ্গি ছিল তার সঙ্গে উলামাদের নেতৃত্বস্থানীয় প্রতিনিধিদের বিতর্ক তৈরি হবার অন্যতম প্রধান একটি কারণ। তাবলীগ জামায়াতের সঙ্গে তার মতভিন্নতার পেছনেও তার এই দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। [২৬] প্রকৃত বিচারে বলতে গেলে সুফিবাদ ছিল মওদূদীর জন্য মতাদর্শিক বিতর্ক প্রক্ষেপণের একটি প্রধান ক্ষেত্র। এ কারণে আহমেদ মুকাররাম বলেছেন যে এই বিতর্ক হল ব্যক্তিগত হেদায়েত ও অনুশীলন-নির্ভর জ্ঞানকান্ডের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী সামষ্টিক শাসন-নির্ভর জ্ঞানকান্ডের যে বিরোধ তার একটি প্রতীকী রুপ। [২৭]

মওদূদী তার দ্বিতীয় ধরণের জাহিলিয়াতের অন্তর্ভুক্ত তৃতীয় অনুষঙ্গ হিশেবে সর্বেশ্বরবাদী ও ঈশ্বরংশবাদী পদ্ধতিসমূহের যে সমালোচনা করেছেন তা-ও তার সুফিবাদ সম্পর্কিত বিরূপ ধারণার সঙ্গেই সম্পর্কিত। সুফিবাদকে মওদূদী যেভাবে বুঝেছিলেন তা হল এই রকম – কোন অস্তিত্বই আল্লাহর বাইরে অস্তিত্বমান নয় অর্থাৎ কোন অস্তিত্বই তার নিজ সত্তা থেকে উৎপন্ন হয় নি, সব অস্তিত্ব প্রকৃত বিচারে এক আল্লাহর সৃষ্টি; এর অর্থ হল “all existing things [tamām mawjūdāt] are the outer manifestations of the one being [ek hī wujūd kā ẓuhūr-i khārijī], only this being exists, everything else does not”. [২৮] এই বিশ্বাস, মওদূদী যুক্তি প্রয়োগ করে বলেছেন, মানুষকে সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতাহীন করে তোলে এবং তাকে স্রষ্টার একটি পাপেট বা পুতুলে পরিণত করে। ফলতঃ মানুষ তার উদ্যম হারিয়ে ফেলে এবং অক্রিয় ও অজ্ঞ হয়ে পড়ে; এবং সে অবাধে কেবলমাত্র তার ব্যক্তিগত আসক্তি পূরণে নিয়োজিত হয়ে যায়; তার এই কর্মকান্ড তার জন্য কি পরিণতি বয়ে আনতে পারে তার সেই বিবেচনাবোধ হারিয়ে যায়। [২৯]

এই বিশ্লেষণের আলোকে মওদূদী সিদ্ধান্ত নেন যে উল্লেখিত দুটি পদ্ধতির কোনোটিই জীবনের মৌলিক প্রশ্নাবলীর সন্তোষজনক উত্তর দেবার জন্য উপযুক্ত নয়। এ পর্যন্ত পর্যালোচিত সব পদ্ধতিই, তিনি বলেন, অজ্ঞতার উপরে গড়ে উঠেছে, ইলমের উপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠেনি; এ কারণে এদের যে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিণতি হবার কথা তা-ই হয়েছে। একটি অচেনা ও অজানা বিশ্বের মুখোমুখি হয়ে, মওদূদী মত প্রকাশ করেন, মানুষ হয়ত একটি অজ্ঞতা এবং বিহ্বলতার পরিবেশে নিজেকে আবিস্কার করেছিল; এবং সে কারণে যা তার ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করেছিল তাকেই সত্য বা বাস্তব বলে মেনে নিয়েছিল। [৩০] কিন্তু এর নেতিবাচক পরিণতি যা হয়েছিল তার ফলে মানুষকে শেষপর্যন্ত এর একমাত্র সম্ভাব্য বিকল্প হিশেবে নবী রাসুলদের বাণীকেই গ্রহণ করতে হয়েছে। কারণ এই বাণীতেই রয়েছে সত্য বা হাকিকতের প্রকৃত ব্যাখ্যা। এই বাণী, যা ইসলামী পথ বা তরিকা বলে পরিচিত তাই, মওদূদীর মতে, একটি বৈজ্ঞানিক পথ যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং সঙ্গতিপূর্ণ উপায়ে জীবনের যাবতীয় মৌলিক প্রশ্নাবলীর সদুত্তর দিতে সক্ষমঃ “Whenever you are confronted with such a situation [ṣurat-i ḥāl] your first endeavour is to search for a person who claims to know a solution. Then, on the basis of circumstantial evidence [qarāʾin se], you seek to satisfy yourself regarding whether or not such a person is trustworthy [qābil-i iʿtimād]. Then you go ahead under this guidance. When it is proven by experience [tajriba se thābit ho jātā he] that the information he provided has not led to any negative result whilst you acted on it, then you are convinced that this person possessed the requisite knowledge and that this information [maʿlūmāt] supplied by him […] was sound [ṣaḥīḥ]. This is a scientific way, and if there is not any other scientific way, then this must be the only correct one for formulating one’s viewpoint [rāʾy].” [৩১]

এখান থেকে বোঝা যায় যে মওদূদী তার সমকালীন পশ্চিমা বিজ্ঞানের জয়জয়কার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তার ভাষ্যকৃত ইসলামকে একটি বিজ্ঞানসম্মত ইসলাম হিশেবে উপস্থাপন করেছিলেন। এদিক থেকে মওদূদীকে নিঃসন্দেহে তার সময়ের সন্তান হিশেবে গণ্য করা যায়।

মওদূদী ইসলামকে একটি সর্বগামী পথ হিশেবে বুঝেছিলেন। কাজেই এই ইসলাম কখনোই জাহিলিয়াতের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে না। এ কারণে তিনি এক পর্যায়ে ১৯৩০ দশকের শেষের দিকে ও ১৯৪০ দশকের প্রথম দিকে তার জাহিলিয়াত ধারণাটির মধ্যে ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা কুফরকেও অন্তর্ভুক্ত করেনঃ “Unbelief means refusal to obey God; Islam means […] refusal to accept any path, law [qānūn] or order which stands against the guidance sent down from God.” [৩২] এই অনুষঙ্গে তিনি আরো লেখেনঃ “One way to reach a decision in every eventuality has been laid down in the Book of God and in the Sunna of His Messenger other ways are prompted by the desires of your lower self [nafs kī khwāhishāt], by the ways of your ancestors, or by man-made laws. If one discharges the way that God has laid down and decides for some other way, then he basically chooses the path of unbelief. If one had chosen this manner for every aspect of his life then he is a complete unbeliever [kāfir].” [৩৩]

মওদূদী এখানে যেভাবে জাহিলিয়াত ও কুফরকে একাকার করে দিয়েছেন তা ভবিষ্যতের জন্য একটি নেতিবাচক সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে রেখেছিল। এই সম্ভাবনাকে বাস্তবিকই পরবর্তীকালে আরব বিশ্বে তার অতি উৎসাহী অনুসারীরা তাদের মত করে ব্যবহার করেছে। [৩৪] এ থেকে এটাও বোঝা যায় যে কুফরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার সূত্রে মওদূদীর জাহিলিয়াত প্রত্যয়টির একটি আইনগত দিকও রয়েছে; এ থেকে যে অনুসিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় সেটা হল এই যে মওদূদী ইসলামকে যেভাবে উপস্থাপন করেছেন সেভাবে ইসলাম অনেকগুলো বিকল্পের মধ্যে কেবলমাত্র একটি বিকল্প নয়, কিংবা অনেক বিকল্পের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বিকল্পও নয়, বরঞ্চ এটিই একমাত্র বৈধ বিকল্প বা সত্য। কাজেই এটা প্রমাণ করে যে মওদূদীর কাছে জাহিলিয়াত হল এমন একটি বর্গীয় (categorical) প্রত্যয় যা সম্পূর্ণভাবে ইসলামের বিপ্রতীপ। অন্যকথায় জাহিলিয়াত অহিভিত্তিক শরিয়াতের আইন অমান্য করার শামিল।

আমরা আগেই জেনেছি যে জাহিলিয়াত ইসলামের সঙ্গে একইসঙ্গে একইসময়ে বিরাজ করতে পারে; এজন্য ইসলামের ধ্রুপদী যুগের মুফাসসির আল-বায়যাভি একথার উপরে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে জাহিলিয়াতের ছায়া বা অবশেষ (আমরু জাহিলিয়া) মুসলিম উম্মাহর মধ্যে থেকে গিয়েছিল। [৩৫] মওদূদীর মতে মানুষের আকলী ক্ষমতাই তাকে নৈতিক শ্রেয়পথ হিশেবে ঐশী হেদায়েতের পথকে বেছে নিতে সহায়তা করে; আর এই পথেই রয়েছে তার জন্য জীবনের যাবতীয় মৌলিক প্রশ্নাবলীর সন্তোষজনক উত্তর। তিনি বলেছেন মানুষকে এই পথে আহবান করার জন্যে যাদেরকে আল্লাহতায়ালা যুগে যুগে প্রেরণ করেছেন তারা হলেন নবী রাসুল। মওদূদী ইসলামের প্রতিকল্প হিশেবে যে জাহিলিয়াতের প্রত্যয় প্রস্তাব করেছেন সেখানে এজন্যেই নবী রাসুলদের এত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান। [৩৬] নবী রাসুলেরা শুধু আল্লাহর বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেন নি তারা এই বাণীর ব্যাখ্যা করে একে স্বীকৃত কর্তৃত্ব হিশেবে অধিষ্ঠিত করেছেন।



রেফারেন্সঃ[১৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৩
[১৪] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৭; দেখুন Machiavelli, Nicolò (1979). Il Principe (De principatibus), Richardson, Brian (ed.), Manchester: MUB., pp. 47–9.
[১৫] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৮
[১৬] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৯
[১৭] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩০-
[১৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৮-
[১৯] al-Ṭabarī, Muḥammad ibn Jarīr (1426/2005), Taʾʾrīkh al-Ṭabarī: taʾrīkh al-umam wa’l-mulūk, al-Jarrāḥ, Nawāf (ed.). 6 vols., Beirut: Dār Ṣādir. II: pp. 530–59.
[২০] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৯
[২১] This debate owed to a considerable extent to the activities of the so-called Ṭarīqa-yi muḥammadiyya around Sayyid Aḥmad Barelwī and Shāh Ismāʿīl Dihlawī (both killed 1246/1831). Their views on the matter, heavily resembling Wahhābī positions, have been enshrined in their Ṣirāṭ al-mustaqīm and Taqwiyyat al-īmān. See, for example, Hartung, Jan-Peter (2004b), Viele Wege und ein Ziel. Leben und Werk von Sayyid Abū l-Ḥasan ʿAlī al-Ḥasanī Nadwī (1914–1999), Würzburg: Ergon. pp. 108–17; Hartung, Jan-Peter (2008), ‘Wahhābīs and Anti-Wahhābīs: The Learned Discourse on Sufism in Contemporary South Asia’, in: Lassen, Søren Christian and Hugh van Skyhawk (eds). Sufi Traditions and New Departures. Recent Scholarship on Continuity and Change in South Asian Sufism, Islamabad: Taxila Institute of Asian Civilizations, pp. 82–110; Riexinger, Martin (2004). Sanāʾullāh Amritsarī (1868–1948) und die Ahl-i-Ḥadīs [sic] im Punjab unter britischer Herrschaft, Würzburg: Ergon, pp. 238–68.
[২২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ২২
[২৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, অধ্যায় বি-১
[২৪] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ২৩-২৫
[২৫] Besides Sufism, Mawdūdī named ‘Neo-Platonism, Yoga, […] Christian monasticism, Buddhism, and so on’ (ibid., p. 23) as examples of monasticism.
[২৬] See, for example, Zakariyyā, Muḥammad (1983). Fitna-yi mawdūdiyyat yā jamāʿat-i islāmī ek lamḥa-yi fikriyya, Sahāranpūr: Kutubkhāna-yi ishāʿat al-ʿulūm.; Nuʿmānī, Muḥammad Manẓūr (1998). Mawlānā Mawdūdī ke sāth merī rafāqat kī sar-guzasht awr ab merā mawqif!, Lucknow: al-Furqān Buk d′ipo. Nadwī, Abū ’l-Ḥasan ʿAlī (1400/1980). Madhhab wa tamaddun, Lucknow: Majlis-i taḥqīqāt wa nashriyyāt-i islām.; Nadwī, Abū ’l-Ḥasan ʿAlī (1400/1980) ʿAṣr-i ḥāḍir meṇ dīn kī tafhīm wa tashrīḥ, Lucknow: Majlis-i taḥqīqāt wa nashriyyāt-i islām.; Nadwī, Abū ’l-Ḥasan ʿAlī (1418/1997), Manṣib-i nubuwwat awr uske ʿālá maqām-i ḥāmilīn, Lucknow: Majlis-i taḥqīqāt wa nashriyyāt-i islām
[২৭] For this terminology, see Mukarram, Ahmed (1992). Some Aspects of Contemporary Islamic Thought;Guidance and Governance in the Work of Mawlana Abul Hasan Ali Nadwi and Mawlana Abul Aala Mawdudi [sic], unpublished PhD dissertation, University of Oxford., pp. 9–11 et passim.
[২৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩৭
[২৯] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩৮-
[৩০] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৪০
[৩১] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১৩০-
[৩২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৭২), খুতবাত – ইসলাম কে বুনিয়াদি আরকান কি এহমিয়াত ওয়া জরুরাত পার দিলনাশিন আওর আসান-আন্দাজ মেঁ ইয়াকিন আফ্রে দালায়েল, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ৮১
[৩৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৭২), খুতবাত – ইসলাম কে বুনিয়াদি আরকান কি এহমিয়াত ওয়া জরুরাত পার দিলনাশিন আওর আসান-আন্দাজ মেঁ ইয়াকিন আফ্রে দালায়েল, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ৮২
[৩৪] Nedza, Justyna (2008). Das takfīr-Konzept im Wandel? Erklärungsversuch zueiner Kategorie heutigen islamistischen Denkens, unpublished MA dissertation, Ruhr-Universität Bochum, pp. 74–97.
[৩৫] al-Bayḍāwī, ʿAbdallāh ibn ʿUmar (1330h). Anwār al-tanzīl wa-asrār al-taʾʾwīl, 5 vols., Cairo: Dār al-kutub al-ʿarabiyya al-kubrá., IV: pp. 162f.
[৩৬] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৪), তাজদিদ ওয়া ইহইয়া ই দ্বীন, দিল্লীঃ মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ৩০-৩৩

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (7th Part)

~সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~

পর্ব-৭

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের ছয়টি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা, জাহিলিয়া, শারিয়া, জিহাদ, খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।



এই সিরিজের পর্ব-৩ এ জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তা সংক্ষিপ্তভাবে ইতিমধ্যে উপস্থাপিত হয়েছে। যেহেতু জাহিলিয়াতের ধারণাটি উস্তাদ মওদূদীর মতাদর্শ নির্মাণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে সেহেতু এই প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ রয়ে গেছে বলে মনে করি। তাই আজকের পর্বে জাহিলিয়াত প্রসঙ্গে মওদূদীর ধারণা নিয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য ও বিশ্লেষণ পরিবেশিত হচ্ছে। পরে যখন এই লেখাগুলি বই আকারে সংকলিত ও সম্পাদিত হবে তখন এই সংযোজনটুকু পর্ব-৩ এর প্রাসঙ্গিক অংশে যুক্ত করা হবে, ইনশাআল্লাহ।


৯. পুনশ্চঃ উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত ধারণা প্রসঙ্গে

মওদূদী – আমরা জানি ইসলামের ইতিহাস শুরু হবার আগে থেকেই জাহিলিয়াতের ধারণাটি প্রচলিত ছিল। আল্লাহর তাওহিদ ও মৌলিক নির্দেশনাবলী হিশেবে সর্বশেষ অহি নাজিল হবার আগে থেকেই জাহিলিয়াত বলতে ইতিহাসের একটি কালপর্বকে বোঝা হত। এই কালপর্বটিকে বলা হত অজ্ঞতা, মূর্তিপূজা এবং অংশীদারিত্বের কাল। অর্থাৎ প্রাক-ইসলাম যুগেই জাহিলিয়াত বলতে যা বোঝাত তা ছিল ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি প্রত্যয়। এভাবে ইতিহাসকে দেখা হত দুটি বিপরীতধর্মী কালের সমাবেশ হিশেবে। ইতিহাসের এই দর্শন কোরআনের বেশ কিছু আয়াতে যেভাবে মানুষের নাজাতের বয়ান এসেছে এবং প্রসঙ্গক্রমে জাহিলিয়াতের কথা এসেছে তার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। [১] জাহিলিয়াত ও ইসলাম – ইতিহাসের এই দুই পর্বের মধ্যখানে থেকে এই দুই পর্বকে সংযুক্ত করেছে মুহাম্মদ স. এর নববী দাওয়াত বা নবুওয়াত।

ইসলামের ইতিহাসে অবশ্য জাহিলিয়াত কালপর্বটিকে একটি একাট্টা কালপর্ব হিশেবে দেখা হত না। জাহিলিয়াত কালপর্বেরও রয়েছে কয়েকটি বিভাগ বা স্তর। ইতিহাসের এই দ্বিমাত্রিক বিভাজন যেন কোরআনের অহিতে বিধৃত ইসলামের বয়ানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হয়েছিল। এই বয়ানে বলা হয়েছিল যে কোরআনের এই অহি পূর্ববর্তী নবী রাসুলদের কাছে নাজিলকৃত অহি সমূহের পুনরাবৃত্তি। এই দৃষ্টিকোণ থেকে কোরআনের ৩৩ নম্বর সুরা আল-আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতে আমরা “প্রথম/প্রাচীন জাহিলিয়াত” (আল জাহিলিয়া আল উলা) শব্দবন্ধটি লক্ষ করি। জাহিলিয়াত পর্বটিকে এভাবে আমরা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত দেখতে পাই, যেমন এর প্রথম পর্বটি হল হজরত আদম আ. থেকে হজরত নূহ আ. পর্যন্ত অথবা হজরত নূহ আ. হতে হজরত ইদরিস আ. পর্যন্ত; আর এর দ্বিতীয় পর্বটি হল হজরত ঈসা আ. থেকে হজরত মুহাম্মদ স. পর্যন্ত। [২] কাজেই প্রাক-ইসলামী যুগ থেকে জাহিলিয়াত শব্দটি প্রচলিত থাকলেও এর সুনির্দিষ্ট অর্থ তৈরি হয়েছে ইসলামের প্রেক্ষিতেই।

জাহিলিয়াত এবং ইসলাম দুটি বিপরীতার্থক বা বিষম শব্দবন্ধ হিশেবে ইতিহাসকে একটি দ্বৈরথ বা সাংঘর্ষিক সম্পর্ক হিশেবে বয়ান করে। এর দ্বারা দুটি পরস্পর বিরোধী ও সাংঘর্ষিক কালপর্ব নির্দেশিত হলেও ইসলামের আবির্ভাবের পরে জাহিলিয়াত যে সম্পূর্ণভাবে বিদূরিত হয়েছে তা কিন্তু নয়। একারণে আশ’আরী ধর্মতাত্ত্বিক এবং কোরআনের ভাষ্যকার আবদুল্লাহ ইবনে উমার আল বায়যাভি (মৃ. ১২৮৬ খ্রি.) ৩৩ নম্বর সুরা আল-আহযাবের ৩৩ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় একদিকে যেমন জাহিলিয়াতকে ইতিহাসের একটি বিশেষ কালপর্ব হিশেবে দেখেছেন, তেমনি অন্যদিকে “প্রাথমিক জাহিলিয়াত” (আল জাহিলিয়া আলা উলা) এবং “আখেরি জাহিলিয়াত” (আল জাহিলিয়া আল আখিরা) এর মধ্যে বিশেষ পার্থক্য নির্দেশ করেছেন। "আখেরি জাহিলিয়াত" বলতে তিনি মুহাম্মদ স. এর নববী দাওয়াতের পরেও যখন সমাজ পুনরায় বিভিন্ন রকমের সাকারবাদে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছিল সেই অবস্থাকে বুঝিয়েছেন। [৩] বায়যাভি এখানে সুস্পষ্টভাবে জাহিলিয়াত বলতে এমন একটি অবস্থার কথা বলেছেন যেখানে তা ইসলামের বিরুদ্ধে অবাধ্যতা বা ফুসুককে নির্দেশ করে। [৪] এই মত অনুযায়ী ইসলাম এবং জাহিলিয়াত একই সময়ে বিরাজ করতে পারে কিন্তু এই দুই অবস্থান দুটি ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক স্তরকে নির্দেশ করে; যা আবার ইতিহাসের দুটি ভিন্ন ভিন্ন কালপর্বের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। [৫]

মুসলিমদের মধ্যে জাহিলিয়াতকে এভাবে একটি নৈতিক অবক্ষয়মূলক অবস্থা হিশেবে দেখাটা ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আমরা দেখতে পেয়েছি; মূলত একদল রক্ষণশীল ধর্মীয় ভাষ্যকারদের ভূমিকার ফল হিশেবে এটা দেখা গেছে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় হাম্বালি আলেম খ্রিস্টীয় তের শতকের ইবনে তাইমিয়া (মৃ. ১৩২৮ খ্রি.) এবং খ্রিস্টীয় আঠারো শতকের মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল ওয়াহাব (মৃ. ১৭৯২ খ্রি.)। [৬] এই ধারাটি উনিশ ও বিশ শতক অবধি বহমান ছিল যা মুহাম্মদ আবদুহু (মৃ. ১৯০৫) এবং রশিদ রিদা (মৃ. ১৯৩৫)-এর রচনায় প্রভাব ফেলেছিল। পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের সেক্যুলার প্রবণতাগুলিও এদের মাধ্যমে জাহিলিয়াতের উপসর্গ হিশেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। [৭] ইতিহাসের এই ধারাবাহিক সালাফি প্রেক্ষাপটেই উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত বিষয়ক নতুন ভাষ্যটিকে দেখতে হবে।

উস্তাদ মওদূদীর জাহিলিয়াত ধারণা উল্লেখিত ইতিহাসের ধারায় অনুস্যূত থেকেই একটি বিশিষ্ট অবস্থান অর্জন করেছে। তিনি তার পূর্বসূরিদের মত জাহিলিয়াতকে যতটা না একটি ঐতিহাসিক কালপর্ব হিশেব দেখেছেন তার চাইতে অনেক বেশি একটি মানস-সাংস্কৃতিক অবস্থা হিশেবে দেখেছেন। তিনি ইসলামের স্বীকৃত টেক্সটগুলিকে যেভাবে একান্ত নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের আলোকে পুনর্পাঠ করেছিলেন তাতে জাহিলিয়াত সম্পর্কে এই ধারণায় উপনীত হয়েছিলেনঃ “The meaning of jahiliyya in islam comprises every course of action which runs counter to the Islamic culture, Islamic morals and conduct, or Islamic mentality; and jahiliyyat-i ula means all those evils in which the people of Arabia and every other people the whole was involved in.” [৮]

১৯৪১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রদত্ত একটি ভাষণে তিনি জাহিলিয়াতের ধারণাটিকে আরো পরিস্কার করেন। তিনি বলেন জাহিলিয়াতের প্রথম অর্থ হল “নির্ভেজাল অজ্ঞতা” (জাহিলিয়াতে খালিসা) – যার বৈশিষ্ট্য হল সম্পূর্ণ নিজের ইন্দ্রিয়ের উপরে নির্ভরশীল হওয়া এবং একমাত্র এর উপরে ভিত্তি করে সকল বিষয়ে মতামত গঠন করা। [৯] জাহিলিয়াতের দ্বিতীয় অর্থটি তিনি করেন এভাবেঃ “[It] is derived from the contemplation over sensations, together with imagination and analogical reasoning .” [১০] জাহিলিয়াতের এই দ্বিতীয় ধরণের অধীনে মওদূদী বহু-ঈশ্বরবাদ, সন্ন্যাসবাদ এবং সর্বেশ্বরবাদ (pantheism - equates all with God) ও ঈশ্বরংশবাদের (panentheism - indicates we are part of God) যাবতীয় প্রবণতাকে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। [১১]

“নির্ভেজাল অজ্ঞতা” হল , মওদূদীর মতে, এমন একটি অবস্থা যেখানে কোন আসমানি দিব্য সার্বভৌমের উপস্থিতি নেই -- যিনি জ্ঞান ও পথপ্রদর্শনের উৎস হতে পারেন। এই অবস্থায় মানুষ একটি প্রাণি প্রজাতির চাইতে আর বেশি কিছু থাকে না; এই মানুষের জন্ম ও অস্তিত্ব কেবলমাত্র আপতিক এবং কোন উচ্চতর অর্থ বা তাৎপর্য বহন করে না; এবং এভাবে এই ঘটনাচক্রের আবর্তে যেমন মানুষ রয়েছে তেমনি বাকী সমগ্র বিশ্বও একই আপতিকতার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। যেহেতু কোনো আসমানি বিধি-বিধানের অস্তিত্ব থাকে না যা মানুষের জীবনকে সুশৃঙ্খল করতে পারতো, সেহেতু সে নিজেই নিজের স্বয়ম্ভূ প্রভু হয়ে বসে; তার অন্য কারো প্রতি দায়-দায়িত্ব এবং জবাবদিহিতা থাকে না। তার কর্মকান্ডের একমাত্র মাপকাঠি হয়ে দাড়ায় তার ব্যক্তিগত সুবিধা আদায় এবং কেবল নিজের চাহিদা পূরণ। [১২]

(চলবে ইনশাআল্লাহ)


রেফারেন্সঃ
[১] দেখুন আল-কোরআন ৩ (আল-ইমরান): ১৫৪; ৫ (আল-মায়েদা): ৫০; ৩৩ (আল-আহযাব): ৩৩; ৪৮ (আল-ফাতহ): ২৬
[২] Muḥammad ibn Jarir al-Ṭabari (1322/2001). Tafsir al-Ṭabari: jamiʿ al-bayan ʿan taʾʾwil ayat al-qurʾan, al-Turki, ʿAbdallah ibn ʿAbd al-Muḥsin (ed.). 26 vols., Cairo et al.: Dar Hajar., XIX: pp. 97–9; Ignaz Goldziher (1961). Muhammedanische Studien, Hildesheim et al.: Olms (reprint from 1888–90)., p. 220.
[৩]ʿAbdallah ibn ʿUmar al-Bayḍawi (1330h). Anwar al-tanzil wa-asrar al-taʾʾwil, 5 vols., Cairo: Dar al-kutub al-ʿarabiyya al-kubrá., IV: pp. 162f.
[৪] ʿAbdallah ibn ʿUmar al-Bayḍawi (1330h). Anwar al-tanzil wa-asrar al-taʾʾwil, 5 vols., Cairo: Dar al-kutub al-ʿarabiyya al-kubrá., IV: p. 163.
[৫] Reinhard Koselleck (1989). Vergangene Zukunft. Zur Semantik geschichtlicher Zeiten, Frankfurt/M.: Suhrkamp, p. 223.
[৬] Ibn Taymiyya (1413/1993), Iqtiḍaʾ al-ṣiraṭ al-mustaqim mukhalifa aṣḥab al-jahim, alḤaristani,ʿIṣam Faris and Muḥammad Ibrahim al-Zaghli (eds), Beirut: Dar al-jil. pp. 79–91 et passim; Esther Peskes (1993). Muḥammad b. ʿAbdalwahhab (1703–92) im Widerstreit. Untersuchungen zur Rekonstruktion der Frühgeschichte der Wahhabiya, Beirut: Steiner), p. 45.
[৭] Muḥammad Rashid Riḍa (1420/1999), Tafsir al-qurʾan alḥakim al-mashhur bi-Tafsiral-manar, Shams al-Din, Ibrahim (ed.). 12 vols., Beirut: Dar al-kutub al-ʿilmiyya., VI: pp. 422f (on 5 [al-Maʾida]: 50)
[৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৪৯-৭২), তাফহিমুল কোরআন, লাহোর: ইদারা ই তরজুমানুল কোরআন, খন্ড ৪, পৃ. ৯১
[৯] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজে মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২২
[১০] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজে মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২২-
[১১] Annemarie Schimmel (1975). Mystical Dimensions of Islam, Chapel Hill, NC: Univ. of North Carolina Press, pp. 147f and 274–86.
[১২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯০), ‘ইসলাম আওর জাহিলিয়াত’, ইসলামি নিজামি জিন্দেগী আওর উসকে বুনিয়াদী তাসাব্বুরাত, দিল্লীঃ মারকাজে মাকতাবা ই ইসলামি, পৃ. ১২৩

সোমবার, ৪ নভেম্বর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (6th Part)

~সাইয়েদ আবুল আ'লা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~


পর্ব-৬



বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।

এই তুলনামূলক পাঠের পাঁচটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা ও জাহিলিয়া, শারিয়া ও জিহাদ প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।



আজকের পর্বে খিলাফাত ও মুলুকিয়াত প্রসঙ্গে ইসলামের এই দুই দিকপালের চিন্তা তাদের রচনা থেকে উদ্ধৃতিসহ উপস্থাপিত হচ্ছে। লেখাটি বেশ বড়। আশা করি যারা আগ্রহী তারা ধৈর্য হারাবেন না। অনিচ্ছাকৃত ভুল ত্রুটির জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে শুধরে নিতে কোন কার্পণ্য করব না। ধন্যবাদ।

৮. খিলাফাত ও মুলুকিয়াত

মওদূদী – খিলাফাত ধারণাটি ইসলামের ইতিহাসের একটি অনুষঙ্গ। প্রাথমিক পর্যায়ে এর অর্থ করা যায় এভাবে যে এরা হলেন রাসুল স. এর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতৃত্বের উত্তরসূরি বা খিলাফাতে রাসুলুল্লাহ। [১] কাজেই এই ইতিহাস-বিধৃত পরিভাষাটি কোরআন অবতরণের পরবর্তীকালের ভাষা ও প্রত্যয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ হল রাসুল স. এর এই উত্তরসূরিরা সরাসরি আল্লাহ কর্তৃক নিয়োজিত হননি। তারা নিয়োজিত হয়েছিলেন উম্মাহর নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধিদের মাধ্যমে। এরা ছিলেন রাসুল স. এর মৃত্যুর পরে মুসলিম উম্মাহর শুরা কর্তৃক নির্বাচিত বৈধ ও স্বীকৃত কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব।

রাসুল স. এর মৃত্যু পরবর্তী ইতিহাসের একজন পর্যালোচনামূলক পর্যবেক্ষক ও গবেষক ছিলেন মওদূদী। বিশেষ করে তৃতীয় খলিফা হজরত উসমানের নেতৃত্ব ও শাসনকালের পর্যালোচনার ক্ষেত্রে তিনি প্রচলিত ভাষ্যের সমালোচনামূলক ভাষ্য রচনা করেছিলেন। আর প্রথম উমাইয়া শাসক মুয়াবিয়া সম্পর্কে তিনি আরো কঠোর সমালোচনামূলক মূল্যায়ন ও মন্তব্য করেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তার এই প্রথাবিরোধী পর্যালোচনা ও সমালোচনা অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।

মওদূদীর কাছে মানুষ কর্তৃক নেয়া সিদ্ধান্ত দ্বীনি বৈধতার প্রশ্নে যথেষ্ট ছিল না। তিনি একারণে খিলাফাত প্রত্যয়টিকে আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্বের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করে দেখতে চাইতেন। তিনি খিলাফাত বিষয়ে কোরআনের সুরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতের ভাষ্য রচনা করতে গিয়ে খিলাফাত প্রত্যয়ের একটি সাধারণ সংজ্ঞায় উপনীত হয়েছিলেনঃ “Khalīfa is one who, in a certain dominion [mulk], exercises the powers [ikhtiyārāt] conferred upon him in the capacity of a deputy [nāʾib kī ḥaythiyyat]. A khalīfa is no Master [mālik] [by himself], but basically the Master’s deputy. His powers are not essentially [dhātī] his own, but were bestowed to him by [his] Master. In reality, he cannot act on his own intent, but his works are entirely done on the Master’s purport.” [২]

কোরআনের সমর্থন নিয়ে মওদূদী এখানে দুটি লক্ষ্য পূরণ করেছেন। প্রথমতঃ তিনি তার খিলাফাত ধারণাটিকে ইসলামের ইতিহাসের খিলাফাত ধারণা থেকে অবমুক্ত করলেন; অর্থাৎ রাসুল স. এর উত্তরসূরি হিশেবে যে খিলাফাতের ধারণা তা থেকে আলাদা করলেন। দ্বিতীয়তঃ তিনি খিলাফাত ধারণাটিকে কর্তৃত্ব ও সার্বভৌমত্বের প্রতিভূ আল্লাহর সঙ্গে মানুষের একটি বিশেষ সম্পর্ক হিশেবে দেখলেন ও বুঝলেন। কাজেই মওদূদীর খিলাফাত ধারণা যতটা ধর্মতাত্ত্বিক ততটা ইতিহাস নির্ভর নয়। তার খিলাফাতের প্রত্যয় হল খিলাফাতুল্লাহ – অর্থাৎ এই পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধিত্ব ও আস্থার ধারক ও বাহক হিশেবে বিশ্বাসী মানব বা মুমিন। খিলাফাতে রাসুলুল্লাহর ধারণা থেকে খিলাফাতুল্লাহর এই ধারণা নিঃসন্দেহে আলাদা। আর আমরা জানি খিলাফাতে রাসুলুল্লাহর ধারণাটি এসেছে ইসলামের ইতিহাস থেকে রাসুল মুহাম্মাদ স. এর রাজনৈতিক ও ধর্মীয় উত্তরসূরি হিশাবে। [৩] এই পার্থক্য বিচারটি অবশ্য একেবারে অভিনব কিছু নয়। মধ্যযুগের উত্তর আফ্রিকার বহুমুখী প্রতিভাধর মুসলিম মনীষী ইবনে খালদুন (মৃ. ১৪০৮) খিলাফাতের এই দুই প্রত্যয়ের মধ্যে একটি ভিন্নতা ইতিপূর্বেই নির্দেশ করেছিলেন। তিনি মূর্ত খিলাফাত (খিলাফাত বি আতলাক) এবং বিমূর্ত খিলাফাত (খিলাফাত আল আম্মা) এই দুই পরিভাষা ব্যবহার করেছিলেন এই সূত্রে। [৪]

মওদূদীর কাছে ইতিহাস নির্ভর খিলাফাতের প্রাসঙ্গিকতা ছিল ততক্ষণ যতক্ষণ তা তাকে ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর অবক্ষয় ও পতনের কারণ ও ফলাফল অনুসন্ধানে ইতিহাসের পুনর্পাঠে সহায়তা করেছে। ইতিহাসের এই পুনর্পাঠের মাধ্যমে তিনি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্ব থেকে যখন মানবের দুনিয়াবী বিষয়ের বিধি-বিধানের দূরত্ব তৈরি হয়েছে তখনই আল্লাহর প্রতিনিধি এবং আস্থা রক্ষক হিশেবে মানবের পতন শুরু হয়েছে। [৫] ইতিহাসের এই পুনর্পাঠ এবং পুনর্বিবেচনার আলোকে মওদূদীর কাছে খিলাফাতে রাসুলুল্লাহর ধারণাটি বেশি আকর্ষণীয় মনে হয় নি। কারণ তিনি কোরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের যে নির্দেশনামূলক রাজনৈতিক তত্ত্ব তৈরি করতে চেয়েছেন তার জন্য খিলাফাতুল্লাহর প্রত্যয়টিই তার কাছে বেশি উপযোগী এবং কার্যকর বলে মনে হয়েছে।

মওদূদী খিলাফাত প্রত্যয়টিকে একটি বিশেষ রাজনৈতিক পরিভাষা হিশেবে বুঝেছিলেন। অর্থাৎ তিনি এই প্রত্যয়টিকে রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার বৈধতা দেয়ার একটি কার্যকর দ্বীনি উপায় হিশেবে বিবেচনা করেছিলেন। এভাবে তার বোঝাপড়া রাজনীতির কোঠায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ার কারণে তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কোরআনের আন-নূর সুরার ৫৫ নম্বর আয়াতটিঃ “God has promised those of you who believe and work righteous deeds [amanū minkum wa-ʿamilū al-ṣāliḥāt] to make them khulafāʾ on earth [la yastakh li fannahum fi’l-arḍ], just as He has made those who lived before them to khulafāʾ.”
এই আয়াতের ব্যাখ্যা করে তিনি তার যুক্তিবিন্যাসে সেটি প্রয়োগ করেছিলেন। তার মতে এটাই হল কোরআনের সেই আয়াত যা “sheds an extraordinarily clear light on the Islamic theory of state [riyāsat].” [৬] তিনি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় আরো বলেছেন যে এখানে একটি মানব সমষ্টির কথা বলা হয়েছে যারা সকলে মিলে এই খিলাফাত প্রতিষ্ঠা করবে। সুরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতের চাইতে সুরা আন-নূরের এই আয়াতের পার্থক্য হল এখানে বলা হয়েছে যে খিলাফাতের মর্যাদা পেতে হলে একটি যোগ্যতার মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হবে – সেটি হল যারা ইমান আনবে এবং তদনুযায়ী আমল করবে কেবল তারাই এই মর্যাদার অধিকারী হবে।

এরপরে মওদূদী ইসলামের ইতিহাসের সেই বিশেষ পর্বটি যা খিলাফাতে রাশেদীন নামে পরিচিত সেই পর্বটিকে রাসুল স. এর উত্তরসূরিতার উজ্জ্বল উদাহরণ হিশেবে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি এই খিলাফাতের গণতান্ত্রিক অনুশীলনকে বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করেন। এর ভেতর দিয়ে মদীনার খিলাফাতে রাশেদীনকে তিনি একটি দ্বীনি দৃষ্টান্ত হিশেবে দেখান; বিশেষ করে শুরার মাধ্যমে এই খিলাফা্তের নির্বাচন প্রক্রিয়া মওদূদীর জন্য একটি অনুসরণযোগ্য নীতি বলে পরিগণিত হয়। এই নীতির আলোকে খলিফারা উম্মাহর দ্বারা সমালোচিত হতে পারতেন এবং তারা উম্মাহর কাছে জবাবদিহি করতে অঙ্গীকারবদ্ধ থাকতেন।

ইবনে খালদুনের ‘মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে যেভাবে খিলাফাত ও মুলুকিয়াতের মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য টানা হয়েছিল মওদূদী পরিভাষাগত সেই বিভাজনকে অনুসরণ করে ১৯৬৬ সালে ‘খিলাফাত ও মুলুকিয়াত’ শিরোনামে একটি বই লেখেন। এই বইতে তিনি ইসলামের ইতিহাসের খিলাফাতে রাশেদীনের বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন করে খিলাফাত প্রত্যয়টিকে মুলুকিয়াত প্রত্যয়ের একটি বিপরীত প্রত্যয় হিশেবে উপস্থাপন করেন। তার মতে যেহেতু কোরআনে মালিক শব্দটি আল্লাহর একটি গুণ হিশেবে অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে, এবং যা প্রখ্যাত অনেক মুফাসসির অনুসমর্থন করেছেন, সেহেতু কোন মানুষ যদি নিজেকে মালিক বলে পরিচয় দেয় তবে তা নিজেকে দৈবসত্তা বলে বিবেচনার শামিল হবে। এটি হবে পরিস্কারভাবে আল্লাহর অধীনতা অস্ব্বীকার করা যা তাঁর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ বলে গণ্য হবে। মওদূদী লিখেছেনঃ “If someone begins either to see himself as the Master [mālik] or to use the powers that were conferred upon him in whatever manner he pleased [man-māne ṭarīqe se], or if he, instead of the True Master, acknowledges someone else as master, follows his aims and executes his rules [aḥkām], then these would be considered as acts of treachery and revolt [ghaddārī awr baghāwat ke af ʿāl].” [৭]

‘খিলাফাত ও মুলুকিয়াত’ গ্রন্থে মওদূদী দেখিয়েছেন যে কিভাবে মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (মৃ. ৬৮০ খ্রি.) উমাইয়া রাজবংশের শাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইসলামী খিলাফাতের মৌলিক সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিনষ্ট করেছিলেন। [৮] মওদূদী জোর দিয়ে বলেছেন যে সঠিক হেদায়েতপ্রাপ্ত খিলাফাতে রাশেদীন ইসলামের দিব্য-গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধকে উচ্চকিত করে তুলে ধরেছিল। [৯] কিন্তু এই চেতনা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটতে শুরু করে প্রথম ফিতনার সময় থেকে অর্থাৎ ৬৫৮-৬১ খ্রিস্টাব্দ থেকে। এই দিব্য-গণতান্ত্রিক চেতনা ও মূল্যবোধই হল খিলাফাতের নির্যাস; এই নির্যাস কোরআন দ্বারা সমর্থিত এবং সে কারণে খিলাফাত হল মুলুকিয়াতের বিপ্রতীপ প্রতিকল্প। খিলাফাতই হল সামাজিক ন্যায়বিচারের গ্যারান্টর এবং মাসলাহা বা সাধারণ কল্যাণে অবদানকারী। অন্যদিকে মুলুকিয়াত হল এর সম্পূর্ণ বিপরীত।

এভাবে সঠিক হেদায়েতপ্রাপ্ত খিলাফাতে রাশেদীন থেকে বেইনসাফী মুলুকিয়াত বা রাজতান্ত্রিক শাসনে অবনমন মওদূদীর ইসলামের ইতিহাস চেতনার আরেকটি প্রমাণ ও সাক্ষী। তার ইসলামের ইতিহাস চেতনা ছিল ক্রমাগত অবনতি ও পতনের চেতনা। এভাবে তার এই ইতিহাস চেতনায় চলে আসে ইসলাম ও জাহিলিয়ার সেই ধ্রুপদী দ্বন্দ্বের মত আরেকটি বয়ান। এক্ষেত্রে এই ইতিহাস হল খিলাফাত ও মুলুকিয়াতের দ্বন্দ্বের মহা আখ্যান। আর মুলুকিয়াত বলতে তিনি শুধু মুসলিম ইতিহাসের উমাইয়া, আব্বাসী, ফাতিমী, মামলুক বা উসমানী রাজবংশ গুলিকেই নির্দেশ করেননি; তিনি এর আওতায় পরবর্তীকালের ও সমকালের সব ধরণের মানব-রচিত শাসন ব্যবস্থাকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তাদেরকেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন যারাই আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্বের বরখেলাপ করেছে। এক্ষেত্রে বিগত দুশ বছরের আধুনিক কালের জাতীয়তাবাদ, উদার গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ফ্যাসিবাদ, নাৎসিবাদ, কমিউনিজম এসবই অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

নাদভী – মওদূদী ও নাদভীর ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে নিহিত আছে তাদের চিন্তা ও কর্মপদ্ধতির পার্থক্যের সূত্র। মওদূদী ছিলেন একজন প্রথাবিরোধী, স্বাধীনচেতা ইসলামের পর্যবেক্ষক, পর্যালোচক, মৌলিক চিন্তক, লেখক ও রাজনীতিক। অন্যদিকে নাদভী ছিলেন মূলত একজন প্রথানুসারী কিন্তু গুণ-মান-পদ্ধতি বিষয়ে আপসহীন একজন বিশিষ্ট শিক্ষক, পন্ডিত, গবেষক ও আরবী বিশারদ লেখক। তাদের এই ব্যক্তিত্ব ও কিছু প্রেক্ষাপটের পার্থক্যের কারণে খিলাফাত ও মুলুকিয়াত বিষয়ে দুজনের মৌলিক মিল থাকলেও তাদের পর্যালোচনার তীব্রতায় ও প্রকাশভঙ্গীতে বেশ পার্থক্য দেখা গিয়েছে। যেমন নাদভীও মওদূদীর মত খিলাফাতে রাশেদীনকে ইসলামের একটি সোনালী সময় হিশেবে চিত্রিত করেছেন। তিনি লিখেছেনঃ “খেলাফাতে রাশেদা ছিলো এমনই এক আদর্শ শাসনযুগ, যার চেয়ে উত্তম ও সমৃদ্ধতর আর কিছু কল্পনা করারও উপায় ছিল না।” [১০]

কিন্তু নাদভীর কাছে খিলাফাতে রাসু্লুল্লাহ হিশেবে খিলাফাতে রাশেদীন যত গুরুত্বপূর্ণ ছিল মওদূদীর কাছে ততটা ছিল না। কারণ মওদূদী ইসলামের একটি রাজনৈতিক ব্যাখ্যা রচনা করেছিলেন। সেখানে আল্লাহর হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্ব ধারণার উপর নির্ভর করে একটি ভবিষ্যমুখী নতুন ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে তিনি একটি তাত্ত্বিক কাঠামো প্রস্তাব করেছিলেন। এই ইসলামী রাষ্ট্র পুনরায় একটি নতুন খিলাফাত হিশেবে বিকশিত হবে এটাই তার রূপকল্প ছিল। তার কাছে তাই কোরআনের আলোকে খিলাফাতুল্লাহর প্রত্যয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্রথমতঃ নাদভীর এমন কোন মননশীল ও সৃজনশীল রুপকল্প তৈরির দায় ছিল না। কাজেই খিলাফাত প্রত্যয়ের বিভিন্ন প্রকারের মধ্যে তার কোন সুস্পষ্ট প্রাধিকারও ছিল না। দ্বিতীয়তঃ ব্যক্তিত্ব, প্রস্তুতি ও লক্ষ্যের ভিন্নতার কারণে নাদভীর ইসলামের ইতিহাস চেতনা তুলনামূলকভাবে বেশি প্রথানুগ ছিল; তা প্রচলিত ও স্বীকৃত বয়ানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ছিল না। তিনিও মনে করতেন যে খিলাফাতে রাশেদীন থেকে উমাইয়া মুলুকিয়াত বা রাজতন্ত্রে অবনমনের মধ্য দিয়ে মুসলিম উম্মাহর অবক্ষয় ও পতনের সূচনা হয়েছিল। তিনি লিখেছেনঃ “মুসলিম উম্মাহর জীবনে অবক্ষয় ও অধঃপতনের সূচনা ছিলো বেশ স্পষ্ট। এমনকি যদি উন্নতি ও অবনতির মধ্যবর্তী পার্থক্য-রেখাটির উপর অঙ্গুলিনির্দেশ করতে বলা হয় তাহলে অতি সহজেই আমরা সেই ঐতিহাসিক রেখাটি চিহ্নিত করতে পারবো যা খিলাফাতে রাশেদা ও আরব-মুসলিম শাসনকে পৃথক করে রেখেছে।” [১১]

উম্মাহর জীবনে মুলুকিয়াত বা রাজতন্ত্রের অশুভ প্রভাব সম্পর্কে তিনি লিখেছেনঃ “...মানবজাতির দুর্ভাগ্য এই যে, খিলাফাতে রাশেদার পর ইসলামী উম্মাহর ইমামাতের মহাগুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বভার ক্রমে এমন লোকদের দখলে চলে গেলো যারা কোনভাবেই এর যোগ্য ছিলো না এবং এজন্য তাদের যথাযথ প্রস্তুতিও ছিলো না। ... ... ... ইসলামের শিক্ষা, আদর্শ ও ভাবধারায় তারা এতটা আত্মস্থ ছিলো না, ইসলামী উম্মাহর নেতৃত্বদানের জন্য যা ছিলো অপরিহার্য। জিহাদী চেতনা ও ইজতিহাদী যোগ্যতা কোনটাই তাদের ছিল না, যা ইসলামী খিলাফাতের গুরু-দায়িত্ব বহন এবং বিশ্বের নেতৃত্ব গ্রহণের জন্য ছিলো জরুরী। আর এটা উমাইয়া ও আব্বাসী উভয় খিলাফাতের ক্ষেত্রেই ছিলো প্রায় সমান সত্য।” [১২]

কিন্তু এইসব মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে নাদভী প্রচলিত ও স্বীকৃত বয়ানের সঙ্গে কোন দ্রোহমূলক ও সাংঘর্ষিক বয়ানের অবতারণা করেন নি। এই কারণে তিনি প্রথানুসারী উলামাদের কাছে তুলনামূলকভাবে বেশি গ্রহণযোগ্য, স্বীকৃত ও অবিতর্কিত।


রেফারেন্সঃ
[১] খিলাফাত শব্দের বিভিন্ন অর্থ পর্যালোচনার জন্য দেখুন, Patricia Crone and Martin Hinds (1986). God’s Caliph: Religious Authority in the First Centuries of Islam, Cambridge: CUP. Pages 4 -- 23
[২] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৪৯--৭২), তাফহিমুল কুরআন, ৪ খন্ড, লাহোরঃ ইদারা ই তরজুমানুল কুরআন, পৃ. ৭০
[৩] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৭), খিলাফাত ওয়া মুলুকিয়াত, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ৯৬, ১৯৬- এবং ২৩৫
[৪] Ibn Khaldūn, ʿAbd al-Raḥmān (1320h). al-Muqaddima li’l-ʿAllāma Ibn Khaldūn, al-Fāsī, Aḥmad ibn Saʿīd (ed.), Cairo: al-Bulāq, Page 181
[৫] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৭), খিলাফাত ওয়া মুলুকিয়াত, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ৯৬ – ১৪৪
[৬] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৭২) ইসলাম কা নজরিয়া কি সিয়াসি, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ৩৮
[৭] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৪৯--৭২), তাফহিমুল কুরআন, ১ম খন্ড, লাহোরঃ ইদারা ই তরজুমানুল কুরআন, পৃ. ৬২
[৮] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৭), খিলাফাত ওয়া মুলুকিয়াত, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ১৪৫—৬১
[৯] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী (১৯৯৭), খিলাফাত ওয়া মুলুকিয়াত, দিল্লী: মারকাজি মাকতাবা ই ইসলামী, পৃ. ৯৩—৯৫
[১০] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাবী (২০১৩), মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো? অনুবাদঃ আবু তাহের মেছবাহ, ঢাকা, দারুল কলম, পৃ. ২১৮
[১১] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাবী (২০১৩), মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো? অনুবাদঃ আবু তাহের মেছবাহ, ঢাকা, দারুল কলম, পৃ. ২৩৭
[১২] সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদাবী (২০১৩), মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো? অনুবাদঃ আবু তাহের মেছবাহ, ঢাকা, দারুল কলম, পৃ. ২৪৩

(চলবে ইনশাআল্লাহ)

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...