সোমবার, ২৮ অক্টোবর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (5th Part)

পর্ব-৫

~সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~


লেখক: মনোয়ার শামসি সাখাওয়াত

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।


এই তুলনামূলক পাঠের চারটি পর্বে ইতিমধ্যে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে উস্তাদ মওদূদী এবং মওলানা নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা ও জাহিলিয়া প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তক ও লেখকের বয়ানের মূলসূত্র ও উদ্ধৃতিসহ বিশ্লেষণ ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।


আজকের পর্বে আবার সারসংক্ষেপ পদ্ধতিতে ফেরত যাচ্ছি। অর্থাৎ কোন রকম উদ্ধৃতি না দিয়ে দুই মনীষীর অভিমতকে সংক্ষেপে নিজের ভাষায় উপস্থাপন করছি। এর একটি কারণ হল গত পর্বটিতে দুজনের রচনা থেকে উদ্ধৃতি দেবার পরে তা কিছু পাঠকের জন্য বুঝতে কঠিন হয়ে গিয়েছিল বলে আমাকে জানানো হয়েছে। তাই আবার প্রথম পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তন করছি। এভাবে কয়েক পর্ব লিখবার পরে আবার দ্বিতীয় পদ্ধতি অর্থাৎ উদ্ধৃতি পদ্ধতি নিয়ে আসব, ইনশাআল্লাহ।


৬. জিহাদ প্রসঙ্গে

মওদূদী – তিনি শুধু প্রতিরক্ষামূলক জিহাদের পক্ষে ছিলেন না। যেহেতু, তার মতে, ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীন বা ঐহিক-পারলৌকিক ব্যবস্থা, সেহেতু ইসলামের রাষ্ট্র শুধু মুসলিম দেশগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকবে না; এটি সমগ্র বিশ্বের জন্য প্রযোজ্য। জিহাদ অনৈসলামিক শাসন দূর করার জন্য ব্যবহৃত হবে এবং সমগ্র বিশ্বে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে। তার ব্যাখ্যা অনুযায়ী জিহাদ ততক্ষণ পর্যন্ত চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত সমগ্র বিশ্ব ইসলামের শাসনাধীনে না আসবে।


মওদূদীর জিহাদ বিষয়ক চিন্তা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন মিশরের সাইয়েদ কুতুব। তিনি মওদূদীর প্রভাবে সবাইকে একটি বিপ্লবী অস্ত্রসজ্জায় প্রস্তুতির আহবান জানিয়েছিলেন। কুতুব মনে করতেন যে যেসব সরকারগুলি যথেষ্ট ইসলামী নয় সেগুলিকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য প্রয়োজনে যেকোন ধরণের হিংসাত্মক কর্মকান্ডের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। কুতুব প্রথম পর্যায়ে জিহাদ প্রশ্নে অনেক কোমল ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে তার জিহাদ বিষয়ক চিন্তা ক্রমাগত কঠোর হয়েছে। অবশ্য তার জিহাদ চিন্তার লক্ষ্য ছিল প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি নয়।


নাদভী – তিনি মওদূদীর সঙ্গে জিহাদের বেশ কিছু অনুষঙ্গ নিয়ে একমত ছিলেন। দুজনই একথা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে জিহাদ প্রতিটি মুসলিমের উপরে একটি অপরিহার্য দায়িত্ব অর্পণ করেছে। তবে নাদভীর সঙ্গে জিহাদ প্রশ্নে মওদূদীর একটি মৌলিক পার্থক্য ছিল। সেটি হল নাদভী জিহাদের অতিরাজনীতিকরণের বিপক্ষে ছিলেন। তিনি এটিকে ইসলামের পাঁচ স্তম্ভের সমতুল্য মনে করাকে সমর্থন করেন নি।



৭. শারিয়া প্রসঙ্গে

মওদূদী – তার মতে শারিয়া আইন হল আল্লাহর আইন যা রাসুল সা. এর মাধ্যমে এই দুনিয়ায় আল্লাহ পাঠিয়েছেন। এর বাইরে বিদ্যমান যে কোন ধরণের আইন হল মানব-রচিত; সুতরাং সেসব আল্লাহর আইন ও হাকিমিয়্যা বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।

মওদূদীর প্রভাব বলয়ে থেকে সাইয়েদ কুতুব শারিয়া ব্যতীত অন্য যে কোন আইনের প্রতি আনুগত্যকে শিরক মনে করতেন। তিনি শারিয়া আইনের ভিত্তিতে ইসলামের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য হিংসাত্মক পন্থা অবলম্বনকে ন্যায্য বলে মনে করতেন।


নাদভী – তিনিও শারিয়া আইনের একজন উৎসাহী প্রচারক ছিলেন। তিনি মওদূদীর মতই বলেছিলেন যে শারিয়া আইন হল আল্লাহর আইন। তিনি একে সব রকমের মানব রচিত আইনের উপরে স্থান পাবার অধিকারী বলে মনে করতেন। শারিয়া আইন দিয়ে ইসলামের প্রতিটি রাষ্ট্র পরিচালিত বা শাসিত হওয়া উচিত বলে তিনি মনে করতেন।


এছাড়াও শারিয়া আইন বিষয়ক আরো কিছু অনুষঙ্গে নাদভী অন্য দুজন অর্থাৎ মওদূদী ও কুতুবের সঙ্গে একমত ছিলেন। কিন্তু নাদভীর সঙ্গে অন্য দুজনের যেখানে মৌলিক পার্থক্য ছিল তা হল এই যে, নাদভী মনে করতেন যে প্রতিটি মুসলিম যে দেশে বসবাস করে, সেই দেশকে যেন নিজ দেশ মনে করে এবং সেই দেশের একজন আইন মান্যকারী নাগরিক হিশেবে যেন নিজের ভূমিকা ও দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে। তবে এর পাশাপাশি সে যদি সবরকম বৈধ পন্থা অবলম্বন করে শারিয়া আইন ভিত্তিক ন্যায়ানুগ সমাজ প্রতিষ্ঠায় আত্মনিয়োগ করে তবে সেটি কোন দোষের বিষয় নয়।



(চলবে)

শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (4th Part)

~সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~

লেখক: মনোয়ার শামসি সাখাওয়াত 

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব আমরা। লেখাটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে থাকবে।


৫. উদ্ধৃতি সহযোগে যুক্তি ও প্রতিযুক্তির বিস্তারণ
এই তুলনামূলক পাঠের প্রথম তিনটি পর্বে সুনির্দিষ্ট কয়েকটি প্রসঙ্গে মওদূদী এবং নাদভীর চিন্তাকে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইসলামী রাষ্ট্র, কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণা ও জাহিলিয়া প্রসঙ্গে বিংশ শতাব্দীর এই দুজন চিন্তকের বয়ানের মূলসূত্র ইতিমধ্যে সন্নিবেশিত হয়েছে।


তিনটি পর্বে আলোচ্য বিষয়বস্তু সংক্ষেপে সারমর্ম বা সারাংশ আকারে পরিবেশিত হবার কারণে সেখানে দুজন চিন্তকের প্রাসঙ্গিক রচনা থেকে কোন উদ্ধৃতি দেয়া হয়নি।


যেহেতু মূলসূত্রগুলো পড়বার ফলে এখন তাদের চিন্তার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে পাঠকদের একটি প্রাথমিক ধারণা ইতিমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে বলে মনে করছি, তাই এবারের পর্বে মওদূদীর চিন্তাকে তার নিজস্ব রচনা থেকে প্রথমে উদ্ধৃত করে উপস্থাপন করব এবং এরপরে নাদভীর রচনা থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে দেখাবার চেষ্টা করব যে তিনি কিভাবে মওদূদীকে খন্ডন করতে চেয়েছেন। কুর’আনের চারটি মৌলিক ধারণাতেই আমরা আপাতত মনোযোগ দেব।


সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদীঃ


মওদূদীর রচনা থেকে প্রথম যে উদ্ধৃতিটি দেব সেটি হল তার ‘কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা’ নামক বই থেকে। এখানে তিনি তার থিসিস বা চিন্তাকল্পের প্রেমিস বা মূলসূত্রটি পেশ করেছেনঃ


“ইলাহ, রব, দীন ও ইবাদাত – কোরআনের পরিভাষায় এ চারটি শব্দ মৌলিক গুরুত্বের অধিকারী। কোরআনের সার্বিক দাওয়াত এই যে, একমাত্র আল্লাহ তায়ালাই একক রব ও ইলাহ; তিনি ব্যতীত অন্য কোন ইলাহ নেই, নেই কোন রব। উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাত-এ কেউ তাঁর শরীক নেই। সুতরাং তাঁকেই তোমাদের ইলাহ ও রব মেনে নাও; তিনি ব্যতীত অন্য সকলের উলুহিয়্যাত-রুবুবিয়্যাতকে অস্বীকার করো। তাঁর ইবাদাত করো, তিনি ছাড়া অপর কারো ইবাদাত করো না। দীনকে একান্তভাবে তাঁর জন্যেই খালেস করো, অন্য সব দীনকে প্রত্যাখ্যান করো।” [১]


এরপরে তিনি তার মূলসুত্রকে বিস্তার করেছেন এভাবেঃ


“এটা স্পষ্ট যে, কোরআনের শিক্ষা অনুধাবন করার জন্যে পরিভাষা চতুষ্টয়ের সঠিক ও পরিপূর্ণ তাৎপর্য অনুধাবন করা একান্ত অপরিহার্য। ইলাহ শব্দের অর্থ কি, ইবাদাতের সংজ্ঞা কি, দীন কাকে বলে – কোন ব্যক্তি যদি তা না জানে তবে তার কাছে সম্পূর্ণ কোরআনই অর্থহীন হয়ে পড়বে। সে তাওহিদ জানতে পারবে না, শের্ক বুঝতে পারবে না, ইবাদাতকে একান্তভাবে আল্লাহর জন্যে নিবেদিত করতে পারবে না, দীনকে করতে পারবে না আল্লাহর জন্যে নির্দিষ্ট। অনুরূপভাবে কারো মানসপটে যদি এ পরিভাষাগুলোর তাৎপর্য অস্পষ্ট ও অসম্পূর্ণ থাকে, তবে তার কাছে কোরআনের গোটা শিক্ষাই অস্পষ্ট থাকবে। কোরআনের প্রতি ঈমান রাখা সত্ত্বেও তার আকীদা ও আমল – বিশ্বাস ও কর্ম – উভয়ই থেকে যাবে অসম্পূর্ণ।” [২]


এর কারণ ও ফল খুঁজতে গিয়ে মওদূদী লিখেছেনঃ


“আরবে যখন কোরআন পেশ করা হয়, তখন প্রত্যেকেই জানতো ইলাহ অর্থ কি, রব কাকে বলা হয়। কারণ তাদের কথাবার্তায় এ শব্দদ্বয় পূর্ব হতে প্রচলিত ছিল। তারা জানতো এ শব্দগুলোর অর্থ কি, কি এর তাৎপর্য। তাই তাদের যখন বলা হলো যে, আল্লাহ-ই একক রব ও ইলাহ, উলুহিয়্যাত ও রুবুবিয়্যাতে আদৌ কারো হিস্যা নেই, তারা তখন ঠিক ঠিকই বুঝতে পেরেছিল। ... ... অনুরূপভাবে ইবাদাত ও দীন শব্দও তাদের ভাষায় প্রচলিত ছিলো পূর্ব হতে। তারা জানতো, আব্দ কাকে বলে, উবুদিয়্যাত কোন অবস্থার নাম। ইবাদাতের উদ্দেশ্য কোন ধরণের আচরণ, দীনের তাৎপর্য কি? তাই তাদের যখন বলা হলো, সকলের ইবাদাত ত্যাগ করে আল্লাহর ইবাদাত করো, সকল দীন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আল্লাহর দীনে দাখিল হও, তখন কোরআনের দাওয়াত বুঝতে তাদের ভুল হয় নি। এ শিক্ষা আমাদের জীবন ব্যবস্থায় কোন ধরণের পরিবর্তন চায়, শোনামাত্রই তারা তা বুঝতে পেরেছিলো।"


"কিন্তু কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার সময় এ শব্দগুলোর যে মৌল অর্থ প্রচলিত ছিল, পরবর্তী শতকে ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত হতে থাকে। শেষ পর্যন্ত এক একটি শব্দ তার সম্পূর্ণ ব্যাপকতা হারিয়ে একান্ত সীমিত বরং অস্পষ্ট অর্থের জন্যে নির্দিষ্ট হয়ে পড়ে। এর এক কারণ ছিল আরবী ভাষার প্রতি সঠিক স্পৃহার অভাব, দ্বিতীয় কারণ ছিল ইসলামী সমাজে যেসব ব্যক্তির উদ্ভব হয়েছে, তাদের কাছে ইলাহ, রব, দীন, ইবাদাতের সে অর্থ অবশিষ্ট ছিলো না, যা কোরআন নাযিল হওয়ার সময় অমুসলিম সমাজে প্রচলিত ছিলো। এ কারণে পরবর্তী কালের অভিধান ও তাফসীর গ্রন্থে অধিকাংশ কোরানিক শব্দের ব্যাখ্যা করা হয়েছে আভিধানিক অর্থের পরিবর্তে এমন সব অর্থে যা পরবর্তী কালের মুসলমানরা বুঝতো। ... ... ...”


“ফল দাঁড়ালো এই যে, কোরআনের মৌল উদ্দেশ্য অনুধাবন করাই লোকের পক্ষে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়লো। ... ... ...”


“এটা সত্য যে, কেবল এ চারটি মৌলিক পরিভাষার তাৎপর্যে আবরণ পড়ে যাওয়ার কারণে কোরআনের তিন-চতুর্থাংশের চেয়েও বেশি শিক্ষা বরং তার সত্যিকার স্পিরিটই দৃষ্টি থেকে প্রচ্ছন্ন হয়ে যায়। ইসলাম কবুল করা সত্ত্বেও মানুষের আকিদা-আমল-বিশ্বাস ও কর্মে যে সকল ত্রুটি পরিলক্ষিত হচ্ছে, এটা তার অন্যতম প্রধান কারণ। সুতরাং কোরআনুল করীমের মৌল শিক্ষা এবং তার সত্যিকার লক্ষ্য স্পষ্ট করে তুলে ধরার জন্যে এর পরিভাষাগুলোর সঠিক ও বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা একান্ত জরুরী।” [৩]




সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভীঃ

এবারে নাদভীর রচনা থেকে কয়েকটি উদ্ধৃতি উপস্থাপন করে আমরা দেখব যে তিনি কিভাবে মওদূদীর উপরোক্ত বয়ানকে খন্ডন করতে চেয়েছেন।


নাদভী কোরআন সম্পর্কে যে প্রচলিত ধারণাটিকে বারবার মওদূদীর উপরোক্ত বয়ানের খন্ডন হিশেবে ব্যবহার করেছেন সেটি হল প্রচলিত এই ধারণাটি -- যে কোরআন নাযিল হয়েছে সহজ আরবীতে এবং সহজ ভাষায় যাতে করে সাধারণ মানুষ তা সহজে বুঝতে পারে। এটিকে তার খন্ডন প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের লক্ষে তিনি কোরআনের একটি প্রাসঙ্গিক আয়াত উদ্ধৃত করে সূচনা করেন তার ‘এপ্রিসিয়েশন এন্ড ইন্টারপ্রিটেশন অফ রিলিজিয়ন ইন মডার্ন এজ’ গ্রন্থটি। এই সমর্থনবাচক পুরো উদ্ধৃতিটি তিনি এই গ্রন্থে প্রয়োগ করেন তার আগেই লেখা ‘সেভিয়ার্স অফ ইসলামিক স্পিরিট’ গ্রন্থ থেকেঃ


“The scripture has clearly laid the tenets of belief and code of conduct, if only because these are meant to be understood and acted upon by every human being:


‘And We never sent a messenger save with the language of his folk, that he might make (the message) clear for them.’

(Ibrahim: 4)


“The meaning of this verse is manifestly clear. The Prophet of Islam too had explained the import of divine revelations and lived up to those precepts so that his followers might not remain in any doubt. The vocabulary of the Quran and its meanings have thus been handed down, from the Prophet, without any break, and have ever afterwards been recognised and accepted by everyone as authentic and genuine, and to which no one raised any objection.” [৪]
নাদভী তার এই প্রতিযুক্তি উত্থাপন করার আগে কুর’আনের চার পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন হয়েছে এবং অস্পষ্ট হয়ে গেছে বলে মওদূদীর দৃষ্টিভঙ্গির সমালোচনা করেন। তিনি বলেন যে এর ফলে মনে হয় যেন সমগ্র উম্মাহ বা এর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের কাছে কুর’আনের সত্য এতদিন অজানা ছিল; এবং দীর্ঘদিন ধরে কুর’আনের পরিভাষা সম্পর্কে উম্মাহ সামগ্রিকভাবে অজ্ঞ ছিলঃ


“On reading these passages one who has not made deep and extensive study and who is not aware of the fact that God has preserved this Ummat from going astray generally, can infer that the reality of the Quran remained hidden from the Ummat or the majority of it, for a long time and the Ummat remained collectively ignorant of the reality of the basic terms round which revolves the whole structure of the Book and on which rests the edifice of its teachings and exhortations and the veil could be lifted only by the middle of twentieth century.” [৫]

তিনি লেখেন যে এর ফলে উম্মাহর কুর’আন বোঝার ক্ষমতার উপর অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছেঃ


“On a cursory look his conclusion may not appear very damaging and serious but its impact on mind and the way of thinking would be far-reaching for it raises doubts in the capabilities of the Ummat which is not only the bearer of the religion and the message but is responsible for its expansion over the world and its elucidation and protection. It also casts doubts on the history of the Ummat and belittles the achievements of its renovators, reformers and religious doctors in scientific and scholarly fields and in their practices. For future also it will raise doubts about the authenticity of what is being said or understood today.” [৬]

মওদূদীর এই দৃষ্টিভঙ্গিকে নাদভী মধ্যযুগের ‘বাতিনী’দের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে তুলনা করে লেখেনঃ


“It will also give strength to the philosophy of ‘the apparent and the hidden’ and the ‘kernel and the shell’ and make religious truths incomprehensible and abstruse riddles which was the way of the different groups of Batinites in different times.” [৭]


রেফারেন্সঃ

[১] সাইয়েদ আবুল আ’লা মওদূদী, কোরআনের চারটি মৌলিক পরিভাষা, অনুবাদঃ গোলাম সোবহান সিদ্দিকী, আধুনিক প্রকাশনী, ঢাকা, জুন ২০০২, পৃ. ৯

[২] প্রাগুক্ত, পৃ. ১১

[৩] প্রাগুক্ত, পৃ. ১১ – ১৩

[৪] S. Abul Hasan Ali Nadwi, Appreciation and Interpretation of Religion in the Modern Age, Translated by Syed Athar Husain, Academy of Islamic Research and Publications, Lucknow, 1982, Page 33

[৫] Ibid, Page 32

[৬] Ibid, Page 32

[৭] Ibid, Page 32



(চলবে)

মঙ্গলবার, ২২ অক্টোবর, ২০১৯

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী : একটি তুলনামূলক পাঠ (3rd Part)

~সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব। 

প্রসঙ্গ -- কুর’আনের মৌলিক পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন ও বোঝাপড়া, এবং জাহিলিয়া -- এ সম্পর্কে দুজনের মতামত উপস্থাপিত হল।

লেখক: মনোয়ার শামসি সাখাওয়াত 

৩. কুর’আনের মৌলিক পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন ও বোঝাপড়া প্রসঙ্গে

মওদূদী – কুর’আনের মৌলিক পরিভাষা যেমন ইলাহ, রব, ইবাদাত এবং দ্বীন – এই চারটি শব্দের অর্থ আরবের জাহিলিয়া এবং নবী মুহম্মদ স. এর সময়কালে যেমন অনেকের কাছে বোধগম্য ছিল পরবর্তীকালে আর তেমন ছিল না। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কুর’আনের এই শব্দগুলির অর্থে পরিবর্তন ঘটেছে। এই শব্দগুলির সম্পূর্ণ অর্থ ক্ষয়ে ক্ষয়ে সেখানে আংশিক ও অস্পষ্ট অর্থ চালু হয়েছে বলে মওদূদী মনে করতেন।

এর ফলে কুর’আনের প্রকৃত অর্থ উদ্ধার করা কঠিন হয়ে গেছে। এই কারণে কুর’আনের চার ভাগের তিন ভাগ অথবা আসল চেতনাই যেন বোঝাপড়ার বাইরে থেকে গেছে। এটিই মানুষের ইমান ও আমলের সমস্যার মূল কারণ বলে মওদূদী মনে করতেন।

নাদভী – কুর’আনের পরিভাষার অর্থ পরিবর্তন প্রসঙ্গে মওদূদীর অভিমত বিষয়ে নাদভী যে গঠনমূলক সমালোচনাটি লেখেন সেখানে তিনি মূলতঃ পাঁচটি প্রতিযুক্তি উত্থাপন করেছিলেন –

ক. মওদূদীর এই বয়ান কুর’আনের অর্থ শেখা ও বোঝার ব্যাপারে মুসলিম উম্মাহর ক্ষমতা সম্পর্কে অহেতুক সন্দেহ সৃষ্টি করে।

খ. মুসলিম উম্মাহ কখনোই কোন যুগে বা কালে সম্পূর্ণভাবে কুর’আনের অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ ও বিভ্রান্ত হয় নি।

গ. ইসলামের রয়েছে ইসলাহ ও তাজদিদের ধারাবাহিক ইতিহাস। মওদূদীর ব্যাখ্যা মেনে নিলে ইসলামের পরম্পরায় মহান সংস্কারক ও মুজাদ্দিদদের অবদানকে খাটো করা হয়।

ঘ. কুর’আনের চার পরিভাষার মওদূদীকৃত সংজ্ঞা ভারসাম্যপূর্ণ নয় বরঞ্চ এই সংজ্ঞায়ন একপেশে ও অতিরাজনীতিকরণের শিকার।

ঙ. ইকামাতে দ্বীন বা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আলোকে মওদূদীর বয়ান দ্বীনের উদ্দেশ্য ও উপায়কে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে পারে না। উদ্দেশ্যকে উপায় এবং উপায়কে উদ্দেশ্য রূপে উল্টো করে দেখার ফলে ইবাদাতের আধ্যাত্মিক অনুশীলনে ঘাটতি দেখা দেয়। শিরক ও বিদাত বিষয়ে অতি সংবেদনশীল হবার ফলে পর্যাপ্ত রুহানী ইরফান ও ইহসানের চর্চা অনুৎসাহিত হয়। 

৪. জাহিলিয়া প্রসঙ্গে

মওদূদী – জাহিলিয়া প্রত্যয়টিকে মওদূদী ইসলামের সম্পূর্ণ বিপরীত ধারণা বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। তিনি জাহিলিয়া বলতে অনেক ধরণের বিশ্ববীক্ষাকে চিহ্নিত করতেন; এইসব বিশ্ববীক্ষায় রয়েছে এমনসব চিন্তা, বিশ্বাস এবং কর্মকান্ড যা আল্লাহর হাকিমিয়া বা সার্বভৌমত্ব এবং দিব্য কর্তৃত্বকে অস্বীকার করে। তিনি এইধরণের জাহিলিয়ার বিরুদ্ধে হিংসাত্মক উপায় অবলম্বনের সম্ভাবনাকে উন্মোচিত রাখতে চান।

নাদভী – ইসলামী নিজামের বাইরে যা কিছু আছে সেসবকে ঢালাওভাবে জাহিলিয়া বলে আখ্যায়িত করাকে নাদভী প্রান্তিক চিন্তা বলে মনে করতেন। তিনি অন্য মতাদর্শের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ করার নীতির বিপক্ষে ছিলেন। তিনি দৃঢ় ও আন্তরিকভাবে মনে করতেন যে ইসলাম একটি বিপ্লবী মতাদর্শ হিশেবে সমকালীন সমাজ ও সংস্কৃতি পরিবর্তনের ক্ষমতার অধিকারী। এক্ষেত্রে ইসলামের বর্তমান সম্ভাবনা সপ্তম শতাব্দীতে জাহেলী আরবের মতই উজ্জ্বল। তিনি রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য সংগ্রাম এবং মতাদর্শিক বিজয়ের জন্য সংগ্রামের মধ্যে স্পষ্টভাবে পার্থক্য নির্ণয় করতেন। যদিও প্রথম ধরণের সংগ্রামের ক্ষেত্রে হিংসাত্মক কর্মকান্ড অনুমোদিত হলেও দ্বিতীয় ধরণের সংগ্রাম সম্পূর্ণ অহিংস পদ্ধতিতে মানুষকে আশ্বস্ত করে পরিচালনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে ইসলামে কোন জোর জবরদস্তি করা যাবে না। আর তিনি আরবদের নেতৃত্বের উপরে অনেক বেশি প্রত্যাশী ছিলেন।

(চলবে)

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী এর একটি তুলনামূলক পাঠ (2nd Part)

~সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯): একটি তুলনামূলক পাঠ~

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব।

আজকে দ্বিতীয় প্রসঙ্গ -- কুর'আনের চার বুনিয়াদী ধারণা -- সম্পর্কে দুজনের মতামত উপস্থাপিত হল।

লেখার : মনোয়ার সামসি সাখাওয়াত 

২. কুর'আনের চার বুনিয়াদী ধারণা প্রসঙ্গে

মওদূদী -- মওদূদী ইসলামের একটি রাজনৈতিক ভাষ্য রচনা করেছিলেন। এই ভাষ্যের মৌলিক ভিত্তি হল কুর’আনের চারটি মৌল প্রত্যয় – ইলাহ, রব, ইবাদাত এবং দ্বীন। কুর’আনের এই চারটি মৌল প্রত্যয়ের সংজ্ঞা তিনি দিয়েছিলেন তাঁর বিখ্যাত ‘কুর’আনকি চার বুনিয়াদী ইসতিলাহে’ গ্রন্থে। এখানে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তিনি মনে করতেন যে এই চারটি প্রত্যয়ের প্রকৃত অর্থ কেবলমাত্র জাহিলিয়া পরবর্তী আরবরা ঠিকঠাক বুঝতে পেরেছিল। অর্থাৎ রাসুল (স.)-এর সময়কালে এই চারটি ধারণাকে যেভাবে আরবরা বুঝতে পেরেছিল পরবর্তীকালের মুসলিমরা আর সেভাবে বোঝেনি। এই ধারণাগুলির প্রকৃত অর্থ অনেকদিন ধরে মুসলিমদের বোধশক্তির আড়ালে চলে গেছে বলে মওদূদী মনে করতেন।

যেমন মওদূদী বলছেন যে ইলাহ বলতে বোঝায় একমাত্র আল্লাহকে, একমাত্র আল্লাহর কর্তৃত্বকে; ইলাহ বলতে শুধু মূর্তি বোঝায় না; আপনি যদি আল্লাহকে মেনে নিয়ে মূর্তিপূজা না করেও যদি এমন কোন ব্যক্তি, বিধি-বিধান ও ব্যবস্থাকে আল্লাহর কর্তৃত্বের স্থানে স্থাপন করেন তাহলে সেগুলিও ইলাহ বলে বিবেচিত হবে; অর্থাৎ সেক্ষেত্রে আপনি আল্লাহকে একমাত্র সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব হিশেবে মেনে নিয়ে সবরকম মূর্তিপূজা বা শয়তানের উপাসনা থেকে বিরত থাকবার পরেও আল্লাহ ছাড়া অন্য ইলাহের আনুগত্য করছেন; অর্থাৎ আপনি শিরক করছেন।

একইভাবে রব বলতেও বোঝায় একমাত্র আল্লাহকে; অর্থাৎ আল্লাহ হচ্ছেন একমাত্র রব বা প্রতিপালক; কিন্তু রব বলতে শুধু কোন মূর্তি বা পুতুলকে অস্বীকার করাই যথেষ্ট নয়; আপনি যদি আল্লাহকে একমাত্র রব বা প্রতিপালক হিশেবে মেনে নিয়েও এমন কোন ব্যক্তি, বিধি-বিধান ও ব্যবস্থাকে আল্লাহর প্রতিপালক সত্তার সমান্তরাল বিকল্প হিশেবে প্রকারান্তরে মেনে নিতে থাকেন তাহলেও আপনি শিরক বা অংশীদারিত্ব করছেন।

এক্ষেত্রে আপনার ইবাদাতও সঠিক হবে না; আপনার ইবাদাত শুধু কিছু রিচুয়াল পালনে সীমিত হয়ে পড়বে; অথচ আপনি আল্লাহর পাশাপাশি ভিন্ন কর্তৃত্বকে (ব্যক্তি, বিধি-বিধান ও ব্যবস্থা) আপনার অজান্তে ইবাদাত করতে থাকবেন; আপনি এভাবে তাগুতের আব্দ হয়ে যাবেন; শিরক বা অংশীদারিত্বের মধ্যে পড়ে যাবেন।   

এর ফলে আপনি আল্লাহর মনোনীত একমাত্র দ্বীন হিশাবে ইসলামকে গ্রহণ করেও বিভিন্ন অনৈসলামী দ্বীনের অনুশীলন সমান্তরালভাবে করতে থাকবেন। অর্থাৎ আপনি দ্বীন হিশেবে ইসলামকে গ্রহণ করে শাহাদা ঘোষণা করেও যদি একমাত্র দ্বীন ইসলামের পাশাপাশি অন্য বিধি-বিধান ও ব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে থাকেন তাহলে আপনি আংশিকভাবে অন্য দ্বীনের অনুসারী হয়ে পড়বেন; এক্ষেত্রেও আপনি শিরক বা অংশীদারিত্বের শিকার হচ্ছেন।

অর্থাৎ মওদূদী ইলাহ, রব, ইবাদাত এবং দ্বীনের এক ব্যাপক সংজ্ঞায়ন করেছিলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি আল্লাহর হাকিমিয়া বা সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব দিয়ে মানুষের সঙ্গে আল্লাহর সম্পর্ক বা ইবাদাতকে যেমন ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন ঠিক তেমনিভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক বা মু’আমালাতকেও দেখতে চেয়েছেন। কুর’আনের এই চারটি মৌল প্রত্যয়ের যে ব্যাপক সংজ্ঞা তিনি তার ভাষ্যে উপস্থাপন করলেন এর ভিত্তিতেই তিনি তার ইসলামি রাষ্ট্রের প্রত্যয়-প্রকল্প পেশ করেছিলেন। একমাত্র ইলাহ ও রব হিশেবে আল্লাহর হাকিমিয়া বা সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই হল দ্বীনের প্রতিষ্ঠা (ইকামাতে দ্বীন)। আর এই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়মিত প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ হল ইবাদাতের উদ্দেশ্য। ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে শরিয়া ভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পাবে এবং সেখান থেকে সমগ্র দুনিয়ায় তা ছড়িয়ে পড়বে এবং খিলাফায় রূপ নেবে।

নাদভী – নাদভী ১৯৪০ সাল থেকে ১৯৪৩ সাল পর্যন্ত মওদূদী এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে নিজেকে জড়িয়েছিলেন। তিনি লখনৌ জামায়াতের আমীর হয়েছিলেন। কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তিনি মওদূদীর ব্যক্তিত্ব ও চিন্তা এবং জামায়াতের প্রশ্নহীন একক নেতৃত্ব সম্পর্কে তার মতপার্থক্যের কারণে জামায়াত থেকে সরে আসেন। তবে মওদূদীর চিন্তা সম্পর্কে তাঁর সমালোচনা বা ক্রিটিক নাদভী প্রকাশ করেন বেশ পরে তাঁর ‘আসর ই হাজির মে দ্বীন কি তাফহিম ওয়া তাশরিহ’ গ্রন্থে যা ১৯৭৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। এতদিন পরে প্রকাশ করা সত্ত্বেও নাদভীকে জামায়াতের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে অনেক নিন্দা অপবাদ শুনতে হয়েছিল। যদিও মওদূদী ও নাদভীর মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধার সম্পর্ক অটুট ছিল। নাদভী তাঁর ছাত্র ও তরুণ মুসলিমদেরকে মওদূদীর রচনাবলী পাঠে উৎসাহিত করতেন; আবার অন্যদিকে মওদূদীও নাদভীকে চিঠি লিখে তাঁর সমালোচনা থেকে তিনি যদি কিছু শেখার থাকে তবে তা শিখবেন বলে জানিয়েছিলেন। 

নাদভী তাঁর গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে মওদূদী ইসলাম বলতে বুঝেছেন আল্লাহকে একমাত্র সার্বভৌম ও আইন প্রণেতা হাকিম হিশেবে একটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সমান হিশেবে। তিনি লিখেছেন যে মওদূদীর হাতে ইলাহ, রব, ইবাদাত এবং দ্বীন – এইসব মৌলিক কুর’আনি ধারণাগুলির রাজনৈতিক ধারণায় অবনমন হয়েছিল। নাদভী বলেছেন এভাবে মওদূদী ইসলামকে মূলত একটি রাজনৈতিক ক্ষমতার বিষয় বানিয়ে ফেলেছেন; আল্লাহ ও মানুষের সম্পর্ককে কেবল একজন সার্বভৌম রাজা এবং তার প্রজার সম্পর্কে নামিয়ে এনেছেন। কিন্তু নাদভি বলছেন যে এই সম্পর্ক শুধু তা নয়, এই সম্পর্ক ‘ভালবাসার’ সম্পর্ক, এই সম্পর্ক ‘হক প্রতিষ্ঠা’র সম্পর্ক – যা মওদূদী যেভাবে এই সম্পর্ককে দেখিয়েছেন তার চাইতে অনেক বেশি ব্যাপক ও গভীর।

নাদভী মনে করতেন মওদূদী ইসলামকে যেভাবে একটি রাজনৈতিক প্রকল্প বানিয়েছেন তা কুর’আনের প্রকৃত অর্থের বিকৃতি সাধন করেছে। উপরন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবানুগ নয় বরঞ্চ বিপজ্জনক। নাদভী লিখেছেন যে আল্লাহ তাঁর অসীম প্রজ্ঞার কারণে জীবনের কিছু বিষয়, যেমন কিভাবে শাসন কাজ চালাতে হবে তার ফায়সালা করার অধিকার মানুষের উপরে দিয়ে দিয়েছেন; অবশ্যই এসব ফায়সালা শারিয়ার বৃহত্তর পরিসরের মধ্যেই হতে হবে; এবং জনকল্যাণের লক্ষ্য এক্ষেত্রে কার্যকর থাকতে হবে। 

নাদভী তাঁর ক্রিটিকে আরো বলেছেন যে মওদূদী যুক্তি প্রদর্শন করে যেকথা বলেছেন -- আল্লাহ নবী রাসুলদের এই দুনিয়ায় ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের মিশন দিয়ে পাঠিয়েছেন -- সেকথা নবুওয়াত সম্পর্কে ইসলামী ধারণার একটি ভুল পাঠ। নবী রাসুলদের প্রধান কাজ হল, নাদভীর মতে, এক আল্লাহর ইবাদাত সম্পর্কে দাওয়াত দেয়া এবং সৎ কাজের আদেশ দেয়া ও অসৎ কাজের নিষেধ করা। সব নবীরা শাসকও ছিলেন না। সত্য হল নবীদের মধ্য থেকে মাত্র অল্প কয়েকজনই শাসক হতে পেরেছিলেন। নাদভী লিখেছেন যে এটা মওদূদীর একটি বড় বিভ্রান্তি যে তিনি মনে করেন যে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের উদ্দেশ্যে আনুগত্যের প্রস্তুতি ও প্রশিক্ষণ-ই হল ইবাদাত; নাদভী মনে করেন যে এই অভিমতের মাধ্যমে ইসলামের মহান ও সুউচ্চ ধারণার অবমাননা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন ইসলাম সম্পর্কে মওদূদীর বোঝাপড়া অনুযায়ী নামাজ এবং আল্লাহর জিকিরের উদ্দেশ্য হল ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম করা; অর্থাৎ এখানে নামাজ উদ্দেশ্য (এন্ড) নয়, নামাজ হল একটি উপায় (মিনস) মাত্র। নাদভী মনে করেন আসলে এর উল্টোটাই সত্য। অর্থাৎ ইসলামী রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হল আল্লাহর ইবাদাত সুনিশ্চিত করা, ইবাদাতের উদ্দেশ্য ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা নয়।

নাদভী মনে করতেন টোটাল ইসলাম প্রতিষ্ঠা বা ইকামাতে দ্বীন যদি হয় শুধুমাত্র ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা তাহলে এই লক্ষ্য পূরণ করার জন্য বিভিন্ন অনৈতিক ধ্বংসাত্মক পন্থা অনুসরণ করার সম্ভাবনাও খুলে যায়। তাই তিনি বলেছেন ইকামাতে দ্বীনের জন্য প্রয়োজন দ্বীনের প্রজ্ঞা; এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য প্রয়োজন গঠনমূলক পন্থা, ধ্বংসাত্মক পন্থা নয়। সামগ্রিক বিরোধিতা পরিহার করে ইকামাতে দ্বীনের জন্য মুসলিমদের দ্বিধাহীন চিত্তে শান্তিপূর্ণ পন্থা অবলম্বন করতে হবে – যেমন সমঝোতা এবং সংস্কার, পরামর্শ/শুরা এবং প্রজ্ঞা। কিছু নামধারী ‘ইসলামী’ দলের হিংসাত্মক পন্থা ব্যবহারের সমালোচনা করে নাদভী আনুগত্য, ভালবাসা, ইমান এবং নাফসের বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপরে অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করেছেন। মুসলিমদের সামনে যেসব বৈধ পন্থা উন্মুক্ত রয়েছে তার সবগুলিকে ইকামাতে দ্বীনের তাগিদে ব্যবহার করতে হবে। যেমন দাওয়াত ও তাবলীগ, সাহিত্য, জন-আলোচনা, স্বেচ্ছাসেবক প্রশিক্ষণ, চরিত্র ও আখলাক দিয়ে অন্যদের প্রভাবিত করা ও জয় করা এবং সরকারের সঙ্গে বিভিন্নভাবে সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে শাসক ও নেতৃত্বকে প্রভাবিত করা -- এইসব কাজ দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।

(চলবে)

সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী এর একটি তুলনামূলক পাঠ (1st part)

~সাইয়েদ আবুল আলা মওদূদী (১৯০৩ – ১৯৭৯) এবং সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নাদভী (১৯১৪ – ১৯৯৯) একটি তুলনামূলক পাঠ~

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মওদূদী এবং নাদভীর অভিমত এখানে পরপর সংক্ষেপে উপস্থাপন করে দুজনের চিন্তার মিল এবং অমিল খুঁজে দেখব।

প্রথম প্রসঙ্গ -- ইসলামী রাষ্ট্র -- সম্পর্কে দুজনের  মতামত উপস্থাপিত হল।

লেখক: মনোয়ার সামসি সাখাওয়াত 


১. ইসলামী রাষ্ট্র প্রসঙ্গে

মওদূদী – মওদূদীর কাছে ইসলামের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব কায়েম করা; এক্ষেত্রে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত দল জামায়াতে ইসলামীকে ইসলামী বিপ্লবের একটি অগ্রবর্তী দল হিশেবে দেখতে চেয়েছেন। এজন্যে তিনি তরুণ প্রজন্মকে যুক্তি দিয়ে ইসলামী ব্যবস্থার উৎকর্ষ বোঝাবার কথা বলেছিলেন। তিনি মনে করতেন যে অন্যান্য ব্যবস্থা যেমন ধনতন্ত্র, সাম্রাজ্যবাদ, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও জাতি-রাষ্ট্র হল বিভিন্ন মানব রচিত একক বা সামষ্টিক তত্ত্ব যার সবই আল্লাহর সার্বভৌমত্ব ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে। ফলে এগুলি সবই ইসলাম ও মানবতা বিরোধী। তিনি মনে করতেন যে সংগ্রাম এবং বিপ্লবের মূল নিহিত রয়েছে দ্বীন বা ধর্মে; অর্থনীতি, রাজনীতি বা সংস্কৃতিতে নয়। এজন্য তিনি চলতি ব্যবস্থা প্রতিস্থাপনের লক্ষে বিকল্প শাসন ব্যবস্থা হিশেবে দিব্য-গণতন্ত্রের ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন।

নাদভী – নাদভী ইসলামী শাসন বলতে যা বুঝেছেন তা সহিংস পন্থায় অর্জন করাকে তিনি উৎসাহিত করেননি; তিনি ইসলামের সত্য অনুসারীদের সংখ্যা বৃদ্ধি করার কথা বলেছেন এবং সেইসঙ্গে শাসকদের সংস্কারের কথাও বলেছেন। তিনি সামাজিক সংস্কার, ধর্মীয় ও রাজনৈতিক পুনর্জাগরণের পক্ষে কথা বলেছেন কিন্তু ইসলামী বিপ্লবের কথা বলেননি। তিনি মওদূদীর তীব্র সমালোচনা করেছেন এই কারণে যে মওদূদী বলেছিলেন যে আল্লাহ নবী রাসুলদের দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করার মিশন দিয়ে। নাদভী মনে করতেন এটা নবী রাসুলদের মিশনকে ভুল বোঝার নামান্তর। তিনি বলেছেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা মানেই দ্বীন বা ধর্ম প্রতিষ্ঠা নয়; ইসলামী রাষ্ট্র সম্পূর্ণ ইসলাম নয় বা ইসলামের মূল লক্ষ্য নয়; এটিকে বরঞ্চ সম্পূর্ণ ইসলাম প্রতিষ্ঠার একটি উপায় হিশেবে দেখতে হবে। অর্থাৎ এটাই এন্ড নয় এটা হল মীনস।

(চলবে)

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...