মঙ্গলবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২০

প্রত্যাঘাত


অভিশপ্ত কাল পর্ব:

-"দামিনী, কোন কিছুর বিসর্জন দিতে পারাও শক্তির পরিচয় দেয়। অাজ নি:সার্থভাবে তোমাকে বিসর্জন দিচ্ছি বলে ভেবনা আমি কাপুরুষ, ভীতু। একবার ভাবো প্রতিদিন নিজের ফ্যাকাশে , নি:স্বাড় রুপ আয়নায় দেখে, কতবার দগ্ধ হবো! এই মনের অাগুনে জ্বলতে, ক'জন দেখবে অামাকে? ক'জন বুঝবে রোজ কতবার মৃত্যু হচ্ছে আমার!"

-"নি:স্বার্থ ত্যাগ করে মহান হতে চাও! আমি তবুও তোমায় কাপুরুষ বলব। সমর্পিত একজনের হাত ধরার সাহস করতে পারলেনা!! তোমার জন্যে বদ্ধ দুয়ারে রোজ ঠুকরে ঠুকরে মরাই শ্রেয়, প্রাপ্য।"

-"দামিনী! অভিশাপ দিলে!"

-"তোমাকে অভিশাপ দেব! নাহ! কিন্তু মনে রেখো, কারোর বোবা কান্নাও অভিশাপ হয়ে ফেরে। ভালো থেকো...."

শব্দহীন মুর্হুতগুলো কখনো কখনো স্বর্গের মতন হয়, যখন প্রেয়সীর দিকে নির্বাক অপলক ভালোবাসার দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকা যায়। ঠিক একিই শব্দহীন মুহুর্ত জ্বলন্ত নরক হয়, যখন প্রেয়সীর দৃষ্টিতে থাকে ঘৃণার, ধিক্কারের নিষ্পলক চাহনি।

দামিনী ঘুরে চলে যেতে থাকে... বাতাসে ভাসে বোবা কান্না।

***********************


- এমন চটজলদি সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন? তাও আবার এত বড় বিষয় নিয়ে? এমন হুটহাট কিছু করবার মানুষ তো আপনি নন সুব্রতদা?
- সবকিছু অত সময় নিয়ে ভেবেও দেখা যায় না, বিনোদ।
- কিন্ত তাই বলে এই! সম্পর্কের এই বেড়াজাল থেকে নিজেকে পারবেন এত দ্রুত মুক্ত করতে? আর, এতো প্রতিজ্ঞা, শপথ! সেসব কি তাহলে ? শুধুই কি আবেগের তোড়ে ভেসে যাওয়া কিছু স্তুতি বাক্য?

- বিনোদ! মাফ কর আমাকে। তুমিও কি এমন ভাবছো আমাকে? তুমিও? তুমি জানো কতটা নি:স্বার্থ, নির্মোহ আমার ভালোবাসা। সে আমার প্রেম নয়, বরং প্রার্থনায় পাওয়া বর। দোহাই, অন্তত তুমি এমন নিষ্ঠু র কথা বলে, আমার ক্ষতকে আরও রক্তাক্ত কর না।

- দু:খিত সুব্রত বাবু, আমি মানতে পারছি না। ক্ষমা করবেন আমাকে। হয়ত নিজেও মেয়ে বলে বুঝতে পারছি। আপনার সিদ্ধান্ত চরম, দূর্দান্ত বলতেই হয় সুব্রত বাবু! আপনি যা করতে চলছেন, তা কোন বড় ত্যাগ নয় মনে রাখবেন। বাহ। যখন মনে হলো, কোন দাবী খাটাতেই পারবেন না, কোন স্বার্থই যখন আর হাসিলও হচ্ছে না, তখন একদম নি:স্বই না হয় করে দেই তাকে! তাই নয় কি?

- বিনোদিনী?

- চুপ। একদম চুপ। আপনি কখনোই প্রেমিক হতে পারেন না। আপনি প্রতারক। নাহ, তার চাইতেও নিকৃষ্ট আপনি। আপনি একজন খুনি। দামিনীকে জীবন্ত হত্যা করলেন সুব্রতদা। জীবন্ত একটি লাশ বানিয়ে দিলেন তাকে, বাহ। ওর জীবন্ত মৃত্যদেহের উপর দিয়ে শুরু করুন আপনার যাত্রা। ভালো থাকবেন। আর হ্যা, প্রার্থনা করি, আপনার ঐ মুখ যেন কখনোই আমার সামনে না আসে।

ঝড়ের বেড়ে এক রাশ ঘৃণা নিয়ে বিনোদিনী দরজার দিকে এগোয়। যাবার বেলায় তার শাড়ির আঁচলে সাথে পড়ার টেবিলে থাকা, দামিনীর দেয়া স্মৃতি, একটি ছবির ফ্রেম গড়িয়ে পরে। কাঁচ ভাঙ্গার শব্দ, এই আবদ্ধ ঘরে যেন বিনোদিনীর অব্যক্ত কান্নার প্রতিধ্বনি।
বিনোদিনী থেমে যায়। ঝুঁকে বসে, আলতো করে কাঁচ সরিয়ে ভাঙা ফ্রেম হতে ছবিটি হাতে তুলে নেয়, দামিনীর হাতের আঁকা ছোট্ট একটি তৈল চিত্র। সে জানে, কারণ এই ফ্রেমটিতো তারই এনে দেয়া। সুব্রত এগিয়ে আসে নেবার জন্যে কিন্ত থমকে দাঁড়ায় বিনোদিনীর অগ্নিঘৃণা ঝরানো দৃষ্টির সামনে। বিনোদিনী ছবিটি বুকে নিয়ে সশব্দে দরজা খুলে বেরিয়ে যায়।


পাশের ঘর থেকে রমা সব শুনে যাচ্ছিল। মুখে আঁচল চেপে নি:শব্দে কেঁদেই যাচ্ছিল। জানে, তার দাদার বুকে বিনোদির বলা প্রতিটি শব্দ কেমন ছুরির ফলার মতন বিধঁছে। কিন্ত, তাতে তার কিছুই করবার নেই।

রমা এসে দাঁড়ায়, তার দাদার সামনে। বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে সুব্রত।

- দাদা, কেন? কেন বলছো না কিছু। অন্তত বিনোদিকে তো সব খুলে বলতে পারো! কেন সইছো এই অপমান, এই মিথ্যে অপবাদ!

সুব্রত ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায়, চোখ শুস্ক, পাথর। অথচ কত করুন সে দৃষ্টি। কতো অপারগতা। এক কষ্টমাখা স্বরে ভেসে আসে...

- নাহ, সম্ভব নয়। ও একটা পশু। ও একটা নরপশু রমা! ও বিনোদকে ছাড়বে না।

************************************************

সেদিন সুব্রতর বাড়ি থেকে বের হয়ে এক প্রকার দৌড়েই যেন যাচ্ছিল বিনোদিনী। তার সমগ্র বুদ্ধি চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকফাটা চিতকার গলার কাছে শক্ত দলার মতন আঁটকে আছে। মনে হচ্ছে দম বন্ধ হয়ে এখুনি বুঝি মারা যাবে। এখন মাতালের মতন টলতে টলতে বাড়ি ফিরছে, তার বুকে কষ্টের পাল্লাটা কার দিকে ভারি, কার জন্যেই বা ভেবে সে বেশি কষ্ট পাচ্ছে, সে জানে না।

এক দিকে দামিনী, তার ছোট্ট বেলার সঙ্গি। তাদের দু'জনকে সবাই বলে এই আত্মা। এই দামিনীর কাছে সুব্রত তার পৃথিবী, তার ধ্যান, জ্ঞান সব। সুব্রতকে সে ভক্তি করে।
আবার অপর দিকে সুব্রতদা! বয়সে দু'বছর বড় হলেও, সুব্রতদা তার পরম পূজোনীয়, খুব কাছের, ভালোবাসার একজন। নিজের আপন দাদাও কখনো এতটা ভালবাসা, এতটা স্নেহ দেয় নি তাকে, যা পেয়েছে সে সুব্রতর কাছে। সে জানে, সুব্রতর প্রতিটি নি:শ্বাসে দামিনী, তার কল্পনা, স্বপ্ন, ইচ্ছে, আকাঙ্খা, বাসনা সকলটা জুড়েই শুধু দামিনী। দামিনীকে ছাড়া সুব্রতদা কখনোই সুস্থ স্বাভাবিক থাকতে পারবে না। তবে কেন সেই ব্যক্তি আকস্মিক সম্পর্ক ভেঙ্গে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল! যেখানে জানে সুব্রতর কাছে তা বিষপানের সমান! তবুও কেন?

বিনোদিনী টলছে, বুকের কাছটায় অসম্ভব এক চাপ অনুভব করছে। দামিনীর সামনে কি করে দাঁড়াবে! কি করে ওকে সাত্বনা দেবে! জানে এত বড় আঘাত কতটা ভয়ংকরভাবেই না ওকে ভেঙ্গে দিয়েছে। কাকাবাবুকেই বা কি বলবে, কি করে সামলাবে সব!
বাড়ির উঠোনে চলে এসেছে কোনরকম, আর পারছে না। চারপাশ হঠাতই অন্ধকার হয়ে এলো। পেছন থেকে দুটো শক্ত পুরষালি হাত বিনোদিনীকে ধরবার আগেই, সে মাথা ঘুরিয়ে উঠোনে পরে গেল, সিড়ির কোঠায় মাথাটা শব্দ করে ঠুকে গেল।


**************************************************************










সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...