বৃহস্পতিবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৬

নুর ইনায়েত খান...গুপ্তচর এক রাজকন্যা.. Spy Princess

"গুপ্তচর এক রাজকন্যা"কে খুঁজতে গিয়ে, নিজেকেই বলতে হলো, "কেন তারে এতদিন জানিনি সখা, দেখিনি সখা!!!"
"তুফানি এক সমুদ্রে এক মৎসকন্যা ভাসিয়েছেল তার জাহাজ
সমুদ্রের গভীরে সে যত যায়
দামাল ঢেউ তার চারপাশে আনন্দে পাক খায়।
কারণ, তার জাহাজে জ্বলছিল এক পিদিম
যার মিঠে রোশনাই পড়ত যার চোখে
উল্লাসে তার হৃদয় উঠত মেতে এক পলকে। "
নুরউন্নিসা ইনায়েত খান (১৪ বছর)
দি ল্যাম্প অফ জয়
নুর ইনায়েত খান (নুরউন্নিসা-'নারীত্বের আলো'), বাবা হজরত ইনায়েত খান, এক ভারতীয় সুফী যাজক, মা ওরা রে বেকার, পরবর্তীতে নাম পাল্টে হয় আমিনা সারদা বেগম, এক পরমাসুন্দরী মার্কিন মহিলা। ভাই-বোন হচ্ছে, বিলায়েত, হিদায়েত এবং ক্লেয়ার।
নুর ছিলেন টিপু সুলতানের বংশধর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এসওই এর গুপ্তচরের ভূমিকায় ছিলেন, পরবর্তীতে যার গন্তব্যের পরিসমাপ্তি ঘটে নাতসিদের দাখোউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, যা অ্যাডলফ হিটলারের জমানায় তৈরি হওয়া প্রথম কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। মিউনিখে খোদ হিটলারের ঘাঁটির কাছে অবস্থিত এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বহুসংখ্যক ইহুদি, জিপসি এবং যুদ্ধবন্দিকে হত্যা করা হয়। এখানে একটা তথ্য দিয়ে রাখি, দাখোউর এর ক্যাম্পের ফটকে খোদাই আছে, "অরবেইট মাকত ফ্রেই" যার বাংলা দাঁড়ায় "কর্মই তোমাদের মুক্তি দেবে", চমৎকার এক রূঢ় পরিহাস।

নুর ইনায়েতের জীবনী আরোও ক'জন লিখেছেন, তবে শ্রাবণী বসুর ঘাটাঘাটি অসাধারণ এক কথায়। যতটুকু তথ্য দেয়া সম্ভব দিয়েছেন। মোদ্দা কথা "নূর" কে, কেমনই বা ছিলেন তিনি, তা বোঝবার জন্যে যথেষ্ট।

ছোট্ট করে শ্রাবণী বসুর কথা..."শ্রাবণী বসু আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থার লন্ডনের সংবাদদাতা এবং টেলিগ্রাফ ও অন্যান্য পত্রপত্রিকায় লেখেন। লিখেছেন কারি: দি স্টোরি অফ দি নেশন'স ফেভারিট ডিশ। সপরিবারে লন্ডনে বাস করেন।"

বইটির অনুবাদ হাতে পেয়েছিলাম, অনুবাদক: পুষ্পল গঙ্গোপাধ্যায়। মূল বইটির নাম: "Spy Princess: The Life of Noor Inayat Khan"

লেখিকার নিজের অনুভূতি থেকে কিছু তুলছি-
"পাঠকের প্রতিক্রিয়ায় আমি অভিভূত। ২০০৬ সালে বইটি প্রকাশিত হয় এবং পাঠকদের মননে গভীর রেখাপাত করে। ২০০৬ সালেই ভারত সরকারের পক্ষ থেকে নূরকে সম্মান জানানো হয়। সুরেনে যে বাড়িতে নূরের ছেলেবেলা কেটেছে, সেটি ঘুরে দেখেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, "নূরের সাহসিকতা এবং ত্যাগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।" ভারতীয় বংশোদ্ভুত হলেও এই প্রথম ভারত সরকারের পক্ষ থেকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় প্রয়াত নূর ইনায়েত খানকে। তাঁকে ঘিরে আগ্রহ ক্রমশ বাড়ছে। তাঁকে নিয়ে তৈরি হয়েছে একটি গানের সিডি, একটি নাটক, কয়েকটি নৃত্যনাট্য। একটি আন্তর্জাতিক ছবিরও তোড়জোড় চলছে।"

নুর একাধারে ছিলেন ভারতীয়, ফরাসাী এবং ইংরেজ। কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারত বা ইংল্যান্ডের তুলনায় নূর ফ্রান্সেই বেশি পরিচিত। ফ্রান্সে তিনি পান বীরাঙ্গনার সম্মান। সে দেশে তাঁকে চেনে ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনের 'মাদলিন' হিসাবে।
নুরকে জানতে গিয়ে আরোও একজনকে জানা হলো, নুরের পিতা ইনায়েত খানকে। উনার শিক্ষক সৈয়দ আবু হাশেম তাঁকে পশ্চিমে সুফি ধর্ম প্রচারের নির্দেশ দেন, যার জন্যে ভারত ছাড়েন ইনায়েত খান।
লেখিকা ইনায়েত খান সম্পর্কেও অনেক তথ্য তুলে ধরেন, তুলে ধরেন তার সুফি ধর্ম প্রচারের কার্যক্রম, উঠে আসে মৌলা বক্শ, সের্গেই টলস্টয় (লিও টলস্টয় এর পুত্র) আরোও অনেকের কথা। পিতার সম্পর্কে তাঁর সন্তানদের মনোভাব ফুটে উঠে এইভাবে...
"একদিন উত্তেজিত নুর বিলায়েতকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'তুমি কি কখনও আব্বার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখেছ?' বিলায়েত দেখেছিলেন, বাবাকে ধ্যানস্থ অবস্থায় দেখার পর নুরের চোখে ফুটে উঠত বিন্দু বিন্দু অশ্রু।"
"'আব্বার ভালবাসা যখন তোমাদের সঙ্গে রয়েছে, তখন ভয় কিসের?' বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নুরকে সাহস ও সান্ত্বনা জুগিয়েছে তাঁর প্রিয় আব্বার এই কথা। এমনকী জার্মান জেলে যখন তাঁর উপর চলেছে অকথ্য অত্যাচার, তখনও বাবার বলা কথার মধ্যেই সান্ত্বনা খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি "
লেখিকা একে একে নুরের জীবন এর ঘটনাগুলো তুলে ধরেন। বোঝা যায় কতটা দারুনভাবেই না উনি ঘেঁটেছেন নুরউন্নিসাকে। তুলে ধরেছেন পিতার মৃত্যুর পর নুর ও তার পরিবারের সংগ্রাম, নুরের জীবনের মোড়গুলোকে করেছেন জীবন্ত, পাঠকদের সামনে।

১৯৪০ সালের ৪ জুন ফজল মনজিলে নুর ও তাঁর ভাই বিলায়েত নেয় এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত যখন তাদের সেই ছোটবেলা থেকে সুফি ধর্মের প্রভাবে গড়ে তোলা অহিংস মনোভাব ধাক্কা খায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল আর্তনাদের সঙ্গে।
যখন বিলায়েত তার বোনের কাছে প্রশ্ন ছোঁড়ে...
"অশুভ শক্তিকে প্রতিহত না করে কীভাবে আধ্যাত্মিক উন্নতির কথা ভাববে? নাতসিদের দৌরাত্ম্য দেখেও কি হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায়?....অহিংসার দোহাই দিয়ে সেই দুস্কৃতীকে হত্যা না করলে তার হাতে নিহত হবে নিরীহ মানুষ। সেক্ষেত্রে তুমি কি তাদের মৃত্যুর জন্যে দায়ী হবে না?"
তারপর যাত্রা শুরু সংগ্রামের দিকে.....
ডব্লিউএএফ-এর সাথে সাক্ষাতকারের কিছু খন্ডচিত্র- যখন ভারতীয় স্বাধীনতার প্রসঙ্গে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়...
"নিজেদের রক্ষার দায়িত্ব নিজেদের হাতেই তুলে নিক ভারতীয়রা"
....
যে সময়টায় ভারত প্রসঙ্গে ব্রিটেন ছিল প্রচন্ড স্পর্শকাতর, সেই সময়টাতে এহেন মতবিরুদ্ধ বক্তব্য তাঁর দৃঢ়চেতনাকেই প্রকাশ করে। স্পষ্ট করেই বলেন, জার্মানের বিরুদ্ধে ব্রিটেন তাঁর পূর্ণ সহায়তা পাবে কিন্তু যুদ্ধের পর ভারতের স্বাধীনতার ব্যাপারে নিজের অবস্থান খতিয়ে দেখবেন। তাঁর নির্ভীক উত্তর টিপু সুলতানের যোগ্য উত্তরসূরী হওয়ার প্রমাণও।

লেখিকার ঘাঁটাঘাটি অসাধারণ, আবারও বললে বাধ্য হচ্ছি। এসওই (স্পেশাল অপারেশনস এক্সিকিউটিভস) এর কাজ কেমন ছিল, কিভাবে গোয়েন্দা বিভাগগুলো তথ্য সংগ্রহ, প্রচার করত, তাদের সাংকেতিক বাক্যগুলো কেমন হত, সিকিউরিটি কোড কেমন ছিল, তাদের অভিনব অস্ত্রগুলো যেমন, মরা ইঁদুরের দেহে বিস্ফোরক, কাঠের গুড়ির মধ্যে লুকিয়ে রাখা গোপন ওয়্যারলেস ট্রান্সমিটার, পশুর বিষ্ঠার মধ্যেও লুকানো হতো বিস্ফোরক। আর এর জন্যে হাইড পার্ক থেকে সংগ্রহ করা হতো ঘোড়ার বিষ্ঠা। এসব কিছু সম্পর্কে মোটামুটি ভাল একটা ধারনা দিয়েছেন। পরবর্তীতে এসওই-এর কর্মকান্ড নিয়ে অনেক প্রশ্নও তোলা হয়, বলা হয় তাদের বোকামি এবং ঢিলেমির জন্যে মাসুল গুনে, জীবন দিয়ে নুরের মত আরোও অনেক এজেন্ট। যাক্ গে সেটা পাঠকদের নিজেদের ঘেঁটে দেখতে হবে।

নুর যেমন মানসিভাবে প্রচন্ড শক্ত একজন মেয়ে ছিলেন আবার তাঁর মনটাও ছিল প্রচন্ড রকমের কোমল। শ্রাবণী বসুর, নুরকে, তাঁর অনুভূতিগুলোকে স্পর্শ করার ইচ্ছে খুব স্পষ্ট করেই ফুটে উঠে নুরের প্রতিটি পদক্ষেপের বিবরনে। নুর তাঁর পরিবারে কাছে গোপন রেখেছিলেন, খুলে বলেনি তিনি যে কতটা সাংঘাতিক এক সংগ্রামের মাটিতে পা দিতে যাচ্ছেন যেখানে ছোট্ট একটি ভুলের একটাই মাসুল...মৃত্যু।

কিভাবে ফ্রান্সে আসেন, কিভাবে সেখানে তাঁর প্রশিক্ষণ চলে, কতটা অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁকে তৈরি হতে হয়, মানসিকভাবে ভীষণ একাকীত্ববোধ, প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর মা কে অনুভব করা প্রায় সবকিছু্ই লেখিকা এতটা সুন্দর করে তুলে ধরেছেন...যে কখনও কখনও আমিও লেখিকার মতো হারিয়ে গিয়েছি নুরের জীবনের কাহিনীতে।


নুর ধরা পরে "রেনি গ্যারি" নামী এক বিশ্বাসঘাতকের কারনে তাও ঠিক ব্রিটেনে ফিরে আসার এক দিন আগে... ভাবা যায়! যখন ফিল্ডে প্রায় সব অপারেটরা ধরা পরেছে আর নয়ত ব্রিটেনে ফিরে গিয়েছে, নুর তখন একাই ফিল্ডে, দূর্দান্ত সাহসীকতার সাথে তাঁর কাজ একাই চালিয়ে যাচ্ছে। ধরা পড়ার পর প্রায় দু'বার নুর চেষ্টা করে পালাবার কিন্তু ভাগ্য আর সাথ দেয় নি। নিয়তি শেষ অবধি তাঁকে টেনে নিয়ে যায় সেই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই।
গেস্টাপো আধিকারিক জোসেফ গেৎজ যখন ধরা পরে, জেরার মুখে স্বীকারোক্তিতে উঠে অাসে অনেক তথ্য। লেখিকার ভাষায়..

"বন্দিনী নুরের মানসিকতা তুবড়ে দিতে পারেনি জার্মানরা। রবার্ট ডাউলেন, গিলবার্ট র্নম্যানের মতো পোড়খাওয়া এজন্টেরা যেখানে অত্যাচার সইতে পারেন নি, সেখানে নিগ্রহ- অত্যাচারের মুখে নুর ছিলেন অবিচল। মনে মনে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার তারিফ করেন জার্মানরাও।"


১৯৪৯ সালে ৫ এপ্রিল মরণোত্তর জর্জ ক্রস সম্মানে ভূষিত হন নুর। এটিই ব্রিটেনের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান। এই প্রশংসাপত্রটিকে লেখা আছে...
"ইংল্যান্ডের রাজার অসীম বদান্যতায় মরণোত্তর জর্জ ক্রস সম্মানে ভূষিত করা হলো অ্যাসিসট্যান্ট সেকশন অফিসার নোরা ইনায়েত খান কে.......প্রথম মহিলা অপারেটর হিসাবে নোরা শত্রু অধিকৃত ফ্রান্সে গোপনে প্রবেশ করেন।....ব্যাপক ধরপাকড়ের ধারা অব্যাহত থাকলেও তিনি নিজের রেডিও পোষ্টটি ছেড়ে দেশে ফিরে আসতে অস্বীকার করেন। তাঁর পোষ্টটি সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ও বিপজ্জনক ছিল। তাঁর অবর্তমানে লন্ডনের সঙ্গে কোনও যোগাযোগের সেতুই ছিলই না তাঁর ফরাসি সহকর্মীদের সামনে। সুতরাং তিনি তাঁদের ছেড়ে ফিরে আসতে অনিচ্ছুক ছিলেন।
গেস্টাপোর হাতে তাঁর চেহারার বর্ণনা ছিল, কিন্তু তারা তাঁকে মাদলিন হিসাবেই জানতেন। এটিই ছিল তাঁর সাংকেতিক নাম। তাঁকে আটক করতে নিজেদের যাবতীয় শক্তি উজাড় করে দেয় তারা।...প্রায় সাড়ে তিনমাস ধরে গেস্টাপোর সমস্ত অভিসন্ধিকে ব্যর্থ প্রমাণ করলেও, এক ব্যক্তির বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে গেস্টাপোর কবলে পরেন তিনি।.......জার্মান পরিকল্পনা সফল করবার জন্যে তাঁর সহযোগিতা অপরিহার্য ছিল। কিন্তু কোন তথ্য জানাতে সরাসরি অস্বীকার করেন তিনি।....১৯৪৩ সালের নভেম্বর মাসে তাঁকে কার্লসরুহ জেলে পাঠনো হয়, সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ফর্ৎসহেইম জেলে।....অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অসহযোগী এক বন্দি হিসাবে গণ্য হন তিনি।.....গেস্টাপো অ্যাসিসট্যান্ট সেকশন অফিসার ইনায়েত খানকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও তিনি নিজের সহকর্মী বা গোপন উদ্দেশ্যের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি।....
১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৪ তারিখে তাঁকে অন্য তিন বন্দির সঙ্গে দাখোউ কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে পৌঁছোনোর পরপরই তাঁকে চুল্লির কাছে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে অ্যাসিসট্যান্ট সেকশন অফিসার নোরা ইনায়েত খান শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তার অবিস্মরণীয় উদাহরণ স্থাপন করেন। "
নোরা অথবা মাদলিন অথবা নুর...নুরউন্নিসাকে জানতে হলে শ্রাবণী বসুর এই বইটি এক মাস্টারপিস নিঃসন্দেহে। লেখিকার প্রতি অনিঃশ্বেষ শ্রদ্ধা, নুরকে আমার কাছে এতটা জীবন্ত করে তোলার জন্যে...লেখিকার লেখা দিয়ে শেষ করছি....
"সেপ্টেম্বর মাসের এক শীতল সকালে নাতসীদের নারকীয় এক ক্যাম্পের কাছে হাঁটু গেড়ে বসতে বলা হয় তাঁকে....শেষ হয়ে যায় তাঁর জীবন। মিত্রবাহিনীর হয়ে আত্মাহুতি দেন তিনি। দাখোউয়ের কালান্তক দহন চুল্লির মধ্যে মিশে রয়েছে প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের চিতাভস্ম। মৃত্যুর এই বেদির কাছেই নুরকে হত্যা করা হয়। বর্তমানে সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে এক সাধারণ অথচ নয়নাভিরাম বাগান। নিজের আত্মবলিদানের ফলাফল দেখে যেতে পারেন নি নুর। তবে নিঃসন্দেহে তিনি চেয়েছিলেন, পরবর্তী প্রজন্ম এক স্বাধীন পৃথিবীকে পাবে। দাখোউয়ের সেই বাগান স্বাধীন পৃথিবীর প্রতি নুরের অমর উপহারের সাক্ষ্য বহন করছে।"




মৃত্যুর আগে তাঁর উচ্চারিত শেষ কথাটি ছিল "লিবার্তে"..."মুক্তি"।

সোমবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৬

আরশিনগর...By Sadat Hossain

ব্যস্ত সময়ের ফাঁক গলে ক্ষণিকের অবসর যখন মেলে যায়, মন জুড়ে বহু দিনের হাহাকার তখন তুঙ্গে উঠে নতুন কোন বইয়ের গন্ধ নেবার। টু বি অনেস্ট, চোখ তখন চেনা কোন লেখকই খোঁজে বেড়ায়। "সাদাত হোসাইন"কে তেমন করে চেনা ছিলনা। কিন্তু বইয়ের মলাটে "আরশিনগর" শব্দটি আমাকে বাধ্য করে পাতা উল্টাবার। লেখক, আমাকে হতাশ করে নি।
এতোটা শক্ত, অথচ কত সহজ করে বলে চলছে বইয়ের প্রতিটি চরিত্রের কথা, সংগ্রাম। চরিত্রগুলো খুব সাধারণ একেকজন, অথচ তাদের জীবনবোধ, দর্শন তাদের করে তোলে হাজারের মাঝে একজন।
ভূমিকাতে লেখক এর নিজস্ব চিন্তার আকর্ষণকে অস্বীকার করতে পারিনি.... "অারশিনগর" এর দ্বারা অনুভব করি এক শক্ত লেখকের উপস্হিতি।
".....প্রতিটি মানুষের মনের ভেতর অজস্র জগত থাকে, সেই প্রতিটি জগতের নিয়ন্তা সে নিজে। সেখানে তার অবাধ স্বাধীনতা, অসীম শক্তি, অপার অনুভূতি। "আরশিনগর" আমার বুকের ভেতরের তেমনি একটি জগতের 'কেরছা'। যেই জগতের নিয়ন্তা আমি নিজেই। অপার ক্ষমতা শুধুই আমার! কিন্তু আসলেই কি তাই!! আসলেই কি একজন লেখক হয়ে উঠতে পারেন তার গল্পের মহা্পরাক্রমশালী নিয়ন্ত্রক! আসলেই কি তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোকে, গল্পগুলোকে ইচ্ছেমতো নিয়ন্ত্রণ করার পরিপূর্ণ ক্ষমতা তার থাকে? নাকি কখনো কখনো কিছু চরিত্র, কিছু ঘটনা হয়ে ওঠে স্বাধীন। নিয়ন্ত্রণহীন। অবাধ্য। সদম্ভে চলে যায় লেখকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। হয়ে ওঠে স্বাধীন এক সত্তা। আমার কিন্তু তাই মনে হয়।"

ম্যাচিউরড শব্দটি এই লেখকের কলমের বেলায় খাটেই। কোন কঠিন শব্দের খেলা নয়...অথচ দৃশ্যগুলো খুব স্পষ্ট চোখের সামনে। সাধারণের মধ্যে অসাধারণত্ব। যদিও ড্রামাটিক কিছু মুভমেন্ট আছে যেটা অবশ্য দরকারও। ওদিক ঘাঁটবনা। কারণ, গল্পই হচ্ছে ড্রামা।
"আরশি মাথা তুলে তাকাল। ভোলানাথের বন্ধ সেলুনের সামনে কাঁঠের খুটি। সেই খুটির গায়ে হাতের তালুর সমান ছোট্ট এক চিলতে আয়না। ঝাপসা হয়ে যাওয়া সেই আয়নার দিকে তাকিয়ে খানিক স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আরশি। তারপর ধীর পায়ে আয়নাটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আয়নার ভেতরে আবছা একটা মানুষ। গতকাল অবধি দেখে আসা সেই একই চোখ, সেই একই নাক, সেই একই মুখ, একই চেহারা। কিন্তু গতকালের সেই আরশি আর এই মানুষটি কি এক? এই মানুষটাকে কি সে চেনে? আরশির হঠাৎ মনে হল, এই জগতে কেউ কাউকে চেনে না। এই জগত আয়নার মতন। উল্টোজগত। এখানে সবকিছু উল্টো।
এই উল্টোজগতের নাম আসলে আরশিনগর।"
গল্প "আরশি"কে ঘিরেই চলছে... হয়তবা তাই মনে হয়, কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে প্রতিটি চরিত্র তার নিজ নিজ গল্পে স্বকীয়। সন্তানকে জন্ম দিতে গিয়ে নিলুফা বানুর মৃত্যু, আর এরপর পুরোটাই পাল্টে যায় চেনা জানা সেই মজিবর। মানসিকভাবে ভেঙে পরা মজিবরের আবেগ যেন কোথাও হারিয়ে যায়...ছোট্ট শিশুটি আগলে থাকে শুধুই আম্বরি বেগমের মায়ার ছায়ায়। মজিবরের ভেতরে কতটা ভালবাসা ছিল নিলুফা বানুর জন্যে তার ছোট্ট একটা দৃশ্য...
"এই নির্জন তারাভরা রাতে, খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে মজিবর মিয়া কাঁদল। তার বুকের ভেতরে কবুতরের পালকের ওমের মতোন স্পর্শ লেগে থাকা সেই অনুভূতিটুকুর জন্য কাঁদল।...কেউ দেখল না, কেউ শুনল না। কিন্তু যিনি এই বিশ্বচরাচর সৃষ্টি করেছেন তিনি জানেন, এই কান্না জগতের শুদ্ধতম কান্না।"
একাত্তুরে সব পরিবার যখন বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে যায় শুকরঞ্জন ডাক্তার ছাড়তে পারেন নি দেশের মায়া...
"বাপের দেশের মাটি, দপদপাইয় হাঁটি।"
এই ছিল তার অনুভূতি। এই চরিত্রটিকে যেমন কাহিনির শুরুতে পাই ঠিক তেমনি কাহিনির শেষেও থাকে এর এক বিশেষ ভূমিকা। ডাক্তার শুকরঞ্জন ও তার স্ত্রী সুজাতা রানী সংসারে কি ভাবে ভান করে চলতে হয় তার এক নিপুন পাঠ দিয়ে যান। তাদের ছেলে আশিষ ও তার জীবনের বোধটাও এক অন্যরকম গল্প। কোন এক অজানা অভিমানে চলতে থাকা আশিষ ও তার জীবনের ঝড়ে আক্রান্ত হয় পাঠকও।
মজিবর মিয়ার উন্নতি তাকে নিয়ে ফেলে ভীষন এক চোরবালিতে...আমরা যাকে বলি "ভিলেজ পলিটিকস্"। যেখানে "লতু হায়দার" এক বিষাক্ত সাপ। কাহিনীর প্রয়োজনে চলে আসে ইমাম হোসেন,তার স্ত্রী কামরুন্নাহার, ছেলে যায়েদ, আতাহার তালুকদার ও তার ছেলের বউ রুবিনা, আরশির সৎমা লাইলি, এককালীন কমিউনিস্ট পার্টির নেতা যশোদা স্যার, লোকামান গ্রুপ, গালকাটা বশিরের গ্রুপ যারা এখন চরমপন্থী কম্যিউনিস্ট এর বিচ্ছিন্ন দল। এক কালে যাদের স্বপ্ন ছিল সুস্থ উন্নত জাতি ও দেশ গড়বার, তাদেরই নীতি এখন হত্যার, অরাযকতার। যযাতিপুরের রঙ্গমঞ্চ পাঠককে ধরে রাখে প্রচন্ড এক আকর্ষণে।

লেখককে একসময় মনে হয়...অ্যাগনস্টিক আবার তার লেখায় স্পিরিচুয়্যালিজম এর এতোটা ছোঁয়া!! আসলে এক ঐশ্বরিক শক্তির খেলার বিবরণ এই "আরশিনগর"। অসীম সত্তার সাথে সীমাবদ্ধ এই মানবজীবনের সম্পর্ক নিয়ে কখনো কখনো ছোঁড়া প্রশ্নগুলো বড্ড ভাবিয়ে তোলে।
"মৃত্যুর পর এই জগতের কোনো কিছুরই কি আর কোনো মূ্ল্য থাকে না? সবকিছুই কি ঢেকে যায় শ্রেফ শূণ্যতায়? যদি তাই হবে, তাহলে এই রাতজাগা তীব্র কষ্ট, এই দিনমান বয়ে বেড়ানো সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস, এই মায়া এই এত এত মমতা, এদের মূ্ল্য কী?"
"আসলে জগতে বিচ্ছিন্ন ভুল বা শুদ্ধ বলতে কি কিছু আছে? না কি সকল কিছু আগে থেকেই নির্ধারিত? পুরো জীবনের এই যে গল্প, এই যে সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্না এ সবই কি পূর্বনির্ধারিত! আমরা কি কেবল পূর্বনির্ধারিত সেই হাসি কান্না সুখ দুঃখের সাজানো পান্ডুলিপিতে অভিনয় করে যাই!"
"...তালুকদার সাব, আল্লাহপাক মানুষের ভালো কাজের প্রতিদান দেন।"
"অারশিনগর" এর ব্যাপ্তি বিশাল, প্রতিটি চরিত্রের গল্পই এক দীর্ঘ আখ্যান। একে পড়তে হয় জানতে হয়, নিজের মত করে....অনুভব করতে হয় একান্তই নিজের মত করে।
ভালো লাগা কিছু কথাগুলো....
এই জগতে মানুষের জন্ম, বেড়ে ওঠা, বেঁচে থাকা সবই মরে যাওয়ার জন্য। মানুষ আসলে মৃত্যুর প্রয়োজনে জন্মায়, বেঁচে থাকে।
"সময় অপেক্ষায় থাকে সময়ের এই ভীষণ অাঁচড়ের দাগ নিয়ে। কোন একদিন তা নিভৃত রাতের কান্না হবে। হাসি হবে। সুখ-দু:খ হবে। মানব জীবন কি অদ্ভুত খেয়ালে বাঁধা থাকে সময়ের অমিত অাঁচড়ে।"
গ্রামের একজন অশিক্ষিত মহিলা আম্বরি বেগম, অথচ জীবনবোধ থেকে নেয়া শিক্ষার কি প্রচন্ড সত্যবাণী...যা শিখিয়ে যান শেষবেলায় আরশিকে...
"কাইল কী হইব, সেইটা যদি মানুষ আইজ জানত, তাইলে মানুষ বাঁচতে পারত না। এইটা একটা সুবিধা।.....মানুষের জীবনে এই জন্যেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হইল সময়। আর এই সময়ের খারাপ-ভালো বইলা কিছু নাই। হয় সবই খারাপ, না হয় সবই ভালো।.....সময়ের খারাপ-ভালো কিছু নাই। সময়টাই আসল। যেই সময়টা চইলা যায়, সেই সময়টা আর ফিরা আসে না। কোন চেষ্টায়ই না। সেইটা ভালো হোউক আর মন্দ হোউক।"
জীবনের এক সত্য কঠিন পাঠ রেখে যায় আরশির জন্যে শেষবেলায়....
"জীবন এবং অভিজ্ঞতা এমন এক জিনিষ, যা মানুষকে বয়সের অনেক আগেই বড় করে ফেলে। আবার এই অভিজ্ঞতাই শরীরে যথেষ্ট বেড়ে ওঠার পরও মানুষকে বয়সের চেয়ে অনেক ছোট করে রাখে। "
"জীবন। সে যতটা শেখায়, আর কে পারে তার মতো শেখাতে?"
"জগৎ জুড়ে কী অপার ভালোবাসা ছড়ানো ছিটানো। তার কতটুকুইবা নিতে পারি আমরা! আমরা খুঁজে খুঁজে কেবল ঘৃণা আর দুঃখ নেই। ভালোবাসারা পরে থাকে আড়ালে-আবডালে। "
"মানুষ যতক্ষণ না অবধি অন্য মানুষকে বুঝে উঠতে পারে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ কাউকে ছুঁয়ে দিতে পারে না। মানুষ বেশিরভাগ সময়ই মোহগ্রস্থতাকে ছুঁয়ে যাওয়া ভেবে ভুল করে।"
"জগতের রীতি এক অদ্ভুত চক্র। এই চক্র চলতেই থাকে। ...কেবল মানুষগুলো ভিন্ন। এই চক্রের চালক হচ্ছে সময়। সময় তোমাকে বীজ করবে, চারা করবে, গাছ করবে, বিশাল ছায়াদায়ী বটবৃক্ষ করবে। তারপর ধীরে ধীরে বিস্তৃত শেকড় জুড়ে ঘুণপোকা ধরবে। .....তারপর একসময় মৃত্যু। এই গল্প চলতেই থাকে। অসীম মহাকালের গল্প।"
"মনে হচ্ছে একটা মানব জনমে কিছু মানুষের জন্য রয়েছে অনেকগুলো জগৎ। সেই অনেকগুলো জগতের মধ্যে একটামাত্র জগৎ সত্যি, আর বাদবাকি জগৎগুলো সব মিথ্যে, সব বিভ্রম, সব মায়া।"
"জীবন রোজ খানিকটা করে আয়নার সামনে দাঁড়ানোর মতন। আমরা তাতে শুধু শরীরটাই দেখতে পাই। বুকের ভেতরটা না। অথচ আমাদের দেখার কথা ছিল চোখে। সে দুটোই দেখে, শরীর ও মন।"

জীবনটাকে "যাপন" করে পার করবার মধ্যেই থাকে সার্থকতা। আমরা প্রায়ই "জীবন"কে অস্বীকার করে বসি। ব্যর্থতার গ্লানি ঠিক তখনই জুড়ে বসে। জীবনের সাথে "সখ্যতা" গড়ে তোলা এক চমৎকার গুণ। একে অর্জন করতে হয় "জীবন"এর হাত ধরেই।
শেষ করছি বইয়ের শেষের কিছু লাইন দিয়েই...আর অনুরোধ থাকবে "আরশিনগর"কে নিজের মত করে ঘেঁটে দেখবার জন্যে। আর তার সাথে অনেক ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা রইল লেখকের প্রতি.....
"কী উল্টো নিয়ম এই জগতের! সে জানে তাকে এই হাঁটা শেষে ঠিক ঠিক ফিরে আসতে হবে পেছনের ওই জায়গাটুকুতেই। পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ওই জায়গাটুকুই শুধু শেষ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকে। অপেক্ষায় থাকে একটা মানবজীবনের সবটা সময় জুড়ে। তবুও মানুষ কত কত অপেক্ষায় নির্ঘুম রাত কাটায়। কত কত অপেক্ষার তৃষ্ণায় দিন কাটায়। কী অদ্ভুত এই মানবজনম। কী অদ্ভুত! এ যেন আয়নার মত এক উল্টো জগৎ। এই উল্টো জগতের নাম আসলে আরশিনগর!"

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...