রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৫

আধাঁর বেলা.....সুচিত্রা ভট্টাচার্য

অনেকদিন ঘাঁটা হচ্ছিলনা কোন বই। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য। শেষ আলাপন ছিল বাণীবসুর সাথে। আহা... লেখিকা আমাকে ভালোই পটিয়েছেন। জানি না কেন, সবসময়ই এক অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে যায়, যখনই তার কোন লেখা পড়ি। সব লেখাই যে তার পড়েছি তা নয়, বিশেষ কয়েকটা খুব মন কেড়েছিল। এবার অনেকদিন পর... আবার সেই সুচিত্রা দেবীর ফিরে আসা। "সেন" নন! "ভট্টাচার্য"। সুচিত্রা ভট্টাচার্য।
বিদেশের লাইব্রেরীগুলোতে বাংলা বইয়ের শেলফগুলো দেখলেই... দিল খুশ। নিয়ে পড়ি আর নাই বা পড়ি। বাংলা বই তো আছে!! সেখানেই এক দুপুরে খুঁজে পাওয়া আমার সুচিত্রা দেবীকে। বোধহয় তার লেখা আমার শেষ পড়া ছিল "কাছের মানুষ", ঠিক খেয়াল নেই। যাক্ গে, সুচিত্রা দেবীর... "আঁধার বেলা"।


মধ্যবিত্ত পরিবারের দৃষ্টিকোণ থেকে এক সাম্প্রতিক সময়ের চিত্রপট। সরকারের জমি অধিগ্রহণ, চাষীদের রুখে দাঁড়ানো, আন্দোলন, হতাশা, অপমান, আত্মহত্যা, খুন অবশেষে নোংরা রাজনীতির খেলা। আবার তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, ষাট ছুঁই ছুঁই প্রভাসবাবু ও তার পরিবারের জমি থেকে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের স্বচ্ছতার প্রতি। সুচিত্রা দেবী ভাবিয়েছেন। এক সাধারণ মানুষের নিবা্র্ক অান্দোলন, প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে কাহিনী শেষ। তবে কাহিনী এখানেই শেষ নয়। এক প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন ছুঁড়েছেন প্রতিটি বিবেকবান, সো-কলড্ এডুকেটেড সমাজের দিকে। "উন্নয়ন" বলতে আদৌও কি বোঝায়!
কাহিনী শুরু হয়....
"বাজারের থলি রান্নঘরের দরজায় নামিয়ে একটুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল প্রভাস। আটচল্লিশখানা সিঁড়ি ভেঙে চারতলা ওঠা কি সোজা কথা! বিশেষত এ্ই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে! কী কুক্ষনে যে প্রভাস এত উঁচুতে ফ্ল্যাট কিনতে রাজি হয়েছিল?"

গল্পের শেষ প্যারাটার শুরুটাও ছিল...সেই আটচল্লিশখানা সিড়ি...
"একটা একটা করে সিড়ি ভাঙছিল প্রভাস। দোতলার ল্যান্ডিং এ এসে থামল একটু। শ্বাস নিল। আবার উঠছে। সিড়ির সংখ্যা একই আছে, কিন্তু আটচল্লিশকেই যেন অসীম মনে হয় আজকাল!"


কাহিনী গড়ায় প্রভাস, তার স্ত্রী জয়া, ছেলের বউ আঁখি, আর ছেলে অয়নকে নিয়ে। সদ্য পাওয়া এক প্রস্তাব, জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে এক বিরাট অংকের টাকা পাবার। স্বপ্ন বোনা শুরু হয় পরিবারটির। কিন্তু রুঢ় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় বর্গাদার চাষীদের জন্যে। তাদের জন্যে যারা চাষাবাদ করে জীবন ধারন করতো সেই সব জমিগুলোতে। যা শুধুই তাদের জীবিকার তাড়নায় করা শ্রম ছিলনা। সেই শ্রম ছিল তাদের ভালোবাসা, যেমন ভালোবাসা থাকে সন্তানের প্রতি। শষ্যগুলো ছিল তাদের সন্তান। কত রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তো এদের লালন করা হতো। এতো সহজেই কি হঠাৎ করে ভেঙে দেয়া যায়! এতো দিনের সাধনা! এত দিনেই শ্রম! মানুষগুলো জানার মত যে আর কিছুই জানেনা। শুধুই জানে, রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শষ্যকে লালন করা। চিত্ত, দুলাল, সুভাস, তার মেয়ে শ্যামলী...অন্যায়ের প্রতিবাদী সংগ্রামী এক নারী, এরা উঠে আসে তাদের অনুভূতিগুলো নিয়ে, অনেকের কাছে যা নিতান্তই অবাস্তব।
প্রভাস যখন প্রশ্ন করে সুভাসবাবুর ভেঙে পড়ার কারন... লেখিকা তার কলমে কৃষকদের এক ছবি ফুঁটিয়ে উঠায়....

"কৃষকদের তা হলে আপনি চেনেন না দাদা। চল্লিশ বছর ধরে যে লাঙল ঠেলছে, বীজ ছড়াচ্ছে, সার দিচ্ছে, জমি-মাটি-ফসল ছাড়া যে ভাবতেই শেখেনি...আপনি জানেন, আমার বাবা আর তেমন সক্ষম নেই, তবু লাঠি ঠুকে ঠুকে মাঠে যায়, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে খেতে নেমে ধানের গায়ে হাত বুলোয়, ধানকে আদর করে। বলে, ভালোবাসা না দিলে ফসলের নাকি অভিমান হয়... এই মানুষরা কি আর কোন পেশায় যেতে পারবে? মাটির সঙ্গে তাদের একটা অন্য ধরনের বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে। টাকা দিয়ে এর কোন ক্ষতিপূরণ হয়?"


একদিকে যেমন এই প্রতিবাদ, অন্যদিকে কাহিনী গড়ায় শিক্ষিত বিভাস, অয়নদেরকে নিয়ে, যারা সরকারের সিদ্ধান্তের জাস্টিফিকেশনে ব্যস্ত। অন্যদিকে আবার শিক্ষিতদের আরেক দল.. শ্যামদাদের মত নাট্যকাররাও ভূমিকা নেয়। উঠে আসে রুপকধর্মী এক স্যাটায়ার্। যদিও এর উৎপত্তিস্থল ব্যক্তিগত অপমানের জবাবের মধ্য দিয়ে।
লেখিকা এখানে গ্রিক ট্রাজেডিকে নিয়ে খুব স্বল্পে কিছু বলেছেন যেমন,
"গ্রিক নাটকগুলো বলছে, যে-কোনও বড় ট্রাজেডির ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিবার্যতা থাকে।"



হঠাৎ এরই মাঝে চিত্তর আত্মহনন কাঁপিয়ে দেয় প্রভাসকে। পুলিশের নির্যাতন, নোংরা রাজনীতির প্রবেশ, ঘোলাটে হয়ে যায় সব। স্বার্থের নেশায় নেতা জাতীয় লোকদের কদর্য রুপ উঠে আসে, যারা অবলীলায় ছড়াতে জানে কুৎসিত গন্ধ। পরশমনীর শ্যামলী!!... সে তো এক মেয়ে! আর একজন নারীকে অপমান করবার সবচাইতে বড় অস্ত্র তার শালীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা! যদিও তাকে ভাঙা এতো সহজ নয়।
প্রভাসের টাকার চেক নিয়ে নেয়ার প্রসঙ্গে শ্যমলী যখন বলে উঠে...
"কী বলছেন আপনি কাকাবাবু? এ কি সম্ভব? তাই কি পারি?... যারা আমাদের মানুষ বলেই ভাবেনি, তাদের টাকা ছোঁয়া তো পাপ। তার চেয়ে না খেয়ে মরে যাওয়া ঢের ঢের ভাল।".....যাক্ মেয়েটা এখনও মচকায়নি।"

এই ধরনের আইডলজি দেখতে, পড়তে, ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু মূল্য শোধায় শ্যামলীরা।
শ্যামলীর কথায় প্রভাসের সুর মেলাতে ই্চ্ছে করে কিন্তু আবার কি যেন একটা বাধও সাধে বুকে...
"এ কি সংস্কার? বুকের ভেতর কিছু কিছু ধ্যানধারনা এমনভাবে গেড়ে বসে, সহজে তা যেন সরতে চায় না। চোখের সামনে দেখা অনেক ক্রূর সত্যও যেন তাকে হঠাতে পারে না সহসা।"

আবার স্ত্রী জয়ার কাছে তুলে ধরা কিছু ভাবনা...
"উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, সেখানে পৌঁছোনোর পথটা কখনও নোংরা হতে পারে না। আর যদি নোংরা পথ ধরেই এগোতে হয়, তা হলে উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি মহৎ থাকতে পারে না।"

বোঝা যায় প্রভাসের নেয়া শেষের সিন্ধান্ত তার নিবার্ক প্রতিবাদ..... এমন ভাবনাগুলো তারই আভাস ছিল।

এ কাহিনীতে প্রতিটি চরিত্রই তার নিজ নিজ ভূমিকাতে স্বকীয়। অাঁখি, জয়া, অয়নও। বিপরীতধর্মী মতবাদগুলো নিমিষেই বদলে দেয় কাছের মানুষের রুপ। আবার আত্মিক টান মনে করে দেয় এদের ঘিরেই তো আবর্তন জীবনের। খুব বেশি সম্পর্কের টানপোড়ন কোথাও দেখা যায়না বরং অ্যাডযাস্টমেন্টটা বড্ড পরিচিত। আমরা তো তাই করি। নিজেদের জীবনে! কম্প্রোমাইজ, অ্যাডযাস্টমেন্ট!
কাহিনীর শেষটা এক আশা জাগানো, এক শক্তির আভাস দেয়....প্রভাস যখন শুনে শ্যামলীর ফিসফাস...বাতাসের ধ্বনিতে...
"না কাকাবাবু,। হারছে তো ওরা। ভয় পাচ্ছে বলেই না ভয় দেখাতে এত মরিয়া।"

"অনেক্ষণকর পর বুক ভরে বাতাস টানল প্রভাস। তার ক্ষীণ স্বরটুকু নয় ছড়িয়ে থাক রুদ্রপুরের মাটিতে। ধূলিকণার মতো।......"


***সুচিত্রা ভট্টাচার্য (১০ জানুয়ারী, ১৯৫০- মে ১২ ২০১৫ ইং) বিহারের ভাগলপুরে জন্ম, মৃত্যু নিজের বাসস্থান কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। এককালে ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবি, পরবর্তীতে ডেডিকেটেড লেখিকা।

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...