রবিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৫

আধাঁর বেলা.....সুচিত্রা ভট্টাচার্য

অনেকদিন ঘাঁটা হচ্ছিলনা কোন বই। বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য। শেষ আলাপন ছিল বাণীবসুর সাথে। আহা... লেখিকা আমাকে ভালোই পটিয়েছেন। জানি না কেন, সবসময়ই এক অন্যরকম ভালোলাগায় ভরে যায়, যখনই তার কোন লেখা পড়ি। সব লেখাই যে তার পড়েছি তা নয়, বিশেষ কয়েকটা খুব মন কেড়েছিল। এবার অনেকদিন পর... আবার সেই সুচিত্রা দেবীর ফিরে আসা। "সেন" নন! "ভট্টাচার্য"। সুচিত্রা ভট্টাচার্য।
বিদেশের লাইব্রেরীগুলোতে বাংলা বইয়ের শেলফগুলো দেখলেই... দিল খুশ। নিয়ে পড়ি আর নাই বা পড়ি। বাংলা বই তো আছে!! সেখানেই এক দুপুরে খুঁজে পাওয়া আমার সুচিত্রা দেবীকে। বোধহয় তার লেখা আমার শেষ পড়া ছিল "কাছের মানুষ", ঠিক খেয়াল নেই। যাক্ গে, সুচিত্রা দেবীর... "আঁধার বেলা"।


মধ্যবিত্ত পরিবারের দৃষ্টিকোণ থেকে এক সাম্প্রতিক সময়ের চিত্রপট। সরকারের জমি অধিগ্রহণ, চাষীদের রুখে দাঁড়ানো, আন্দোলন, হতাশা, অপমান, আত্মহত্যা, খুন অবশেষে নোংরা রাজনীতির খেলা। আবার তর্ক-বিতর্কের মধ্য দিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, ষাট ছুঁই ছুঁই প্রভাসবাবু ও তার পরিবারের জমি থেকে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া অর্থের স্বচ্ছতার প্রতি। সুচিত্রা দেবী ভাবিয়েছেন। এক সাধারণ মানুষের নিবা্র্ক অান্দোলন, প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে কাহিনী শেষ। তবে কাহিনী এখানেই শেষ নয়। এক প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন ছুঁড়েছেন প্রতিটি বিবেকবান, সো-কলড্ এডুকেটেড সমাজের দিকে। "উন্নয়ন" বলতে আদৌও কি বোঝায়!
কাহিনী শুরু হয়....
"বাজারের থলি রান্নঘরের দরজায় নামিয়ে একটুক্ষণ হাঁপিয়ে নিল প্রভাস। আটচল্লিশখানা সিঁড়ি ভেঙে চারতলা ওঠা কি সোজা কথা! বিশেষত এ্ই ষাট ছুঁই ছুঁই বয়সে! কী কুক্ষনে যে প্রভাস এত উঁচুতে ফ্ল্যাট কিনতে রাজি হয়েছিল?"

গল্পের শেষ প্যারাটার শুরুটাও ছিল...সেই আটচল্লিশখানা সিড়ি...
"একটা একটা করে সিড়ি ভাঙছিল প্রভাস। দোতলার ল্যান্ডিং এ এসে থামল একটু। শ্বাস নিল। আবার উঠছে। সিড়ির সংখ্যা একই আছে, কিন্তু আটচল্লিশকেই যেন অসীম মনে হয় আজকাল!"


কাহিনী গড়ায় প্রভাস, তার স্ত্রী জয়া, ছেলের বউ আঁখি, আর ছেলে অয়নকে নিয়ে। সদ্য পাওয়া এক প্রস্তাব, জমি অধিগ্রহণের মাধ্যমে সরকারের কাছ থেকে এক বিরাট অংকের টাকা পাবার। স্বপ্ন বোনা শুরু হয় পরিবারটির। কিন্তু রুঢ় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায় বর্গাদার চাষীদের জন্যে। তাদের জন্যে যারা চাষাবাদ করে জীবন ধারন করতো সেই সব জমিগুলোতে। যা শুধুই তাদের জীবিকার তাড়নায় করা শ্রম ছিলনা। সেই শ্রম ছিল তাদের ভালোবাসা, যেমন ভালোবাসা থাকে সন্তানের প্রতি। শষ্যগুলো ছিল তাদের সন্তান। কত রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়েই তো এদের লালন করা হতো। এতো সহজেই কি হঠাৎ করে ভেঙে দেয়া যায়! এতো দিনের সাধনা! এত দিনেই শ্রম! মানুষগুলো জানার মত যে আর কিছুই জানেনা। শুধুই জানে, রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শষ্যকে লালন করা। চিত্ত, দুলাল, সুভাস, তার মেয়ে শ্যামলী...অন্যায়ের প্রতিবাদী সংগ্রামী এক নারী, এরা উঠে আসে তাদের অনুভূতিগুলো নিয়ে, অনেকের কাছে যা নিতান্তই অবাস্তব।
প্রভাস যখন প্রশ্ন করে সুভাসবাবুর ভেঙে পড়ার কারন... লেখিকা তার কলমে কৃষকদের এক ছবি ফুঁটিয়ে উঠায়....

"কৃষকদের তা হলে আপনি চেনেন না দাদা। চল্লিশ বছর ধরে যে লাঙল ঠেলছে, বীজ ছড়াচ্ছে, সার দিচ্ছে, জমি-মাটি-ফসল ছাড়া যে ভাবতেই শেখেনি...আপনি জানেন, আমার বাবা আর তেমন সক্ষম নেই, তবু লাঠি ঠুকে ঠুকে মাঠে যায়, ভাদ্র-আশ্বিন মাসে খেতে নেমে ধানের গায়ে হাত বুলোয়, ধানকে আদর করে। বলে, ভালোবাসা না দিলে ফসলের নাকি অভিমান হয়... এই মানুষরা কি আর কোন পেশায় যেতে পারবে? মাটির সঙ্গে তাদের একটা অন্য ধরনের বন্ধন তৈরি হয়ে গিয়েছে। টাকা দিয়ে এর কোন ক্ষতিপূরণ হয়?"


একদিকে যেমন এই প্রতিবাদ, অন্যদিকে কাহিনী গড়ায় শিক্ষিত বিভাস, অয়নদেরকে নিয়ে, যারা সরকারের সিদ্ধান্তের জাস্টিফিকেশনে ব্যস্ত। অন্যদিকে আবার শিক্ষিতদের আরেক দল.. শ্যামদাদের মত নাট্যকাররাও ভূমিকা নেয়। উঠে আসে রুপকধর্মী এক স্যাটায়ার্। যদিও এর উৎপত্তিস্থল ব্যক্তিগত অপমানের জবাবের মধ্য দিয়ে।
লেখিকা এখানে গ্রিক ট্রাজেডিকে নিয়ে খুব স্বল্পে কিছু বলেছেন যেমন,
"গ্রিক নাটকগুলো বলছে, যে-কোনও বড় ট্রাজেডির ক্ষেত্রে এক ধরনের অনিবার্যতা থাকে।"



হঠাৎ এরই মাঝে চিত্তর আত্মহনন কাঁপিয়ে দেয় প্রভাসকে। পুলিশের নির্যাতন, নোংরা রাজনীতির প্রবেশ, ঘোলাটে হয়ে যায় সব। স্বার্থের নেশায় নেতা জাতীয় লোকদের কদর্য রুপ উঠে আসে, যারা অবলীলায় ছড়াতে জানে কুৎসিত গন্ধ। পরশমনীর শ্যামলী!!... সে তো এক মেয়ে! আর একজন নারীকে অপমান করবার সবচাইতে বড় অস্ত্র তার শালীনতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা! যদিও তাকে ভাঙা এতো সহজ নয়।
প্রভাসের টাকার চেক নিয়ে নেয়ার প্রসঙ্গে শ্যমলী যখন বলে উঠে...
"কী বলছেন আপনি কাকাবাবু? এ কি সম্ভব? তাই কি পারি?... যারা আমাদের মানুষ বলেই ভাবেনি, তাদের টাকা ছোঁয়া তো পাপ। তার চেয়ে না খেয়ে মরে যাওয়া ঢের ঢের ভাল।".....যাক্ মেয়েটা এখনও মচকায়নি।"

এই ধরনের আইডলজি দেখতে, পড়তে, ভাবতে ভালো লাগে। কিন্তু মূল্য শোধায় শ্যামলীরা।
শ্যামলীর কথায় প্রভাসের সুর মেলাতে ই্চ্ছে করে কিন্তু আবার কি যেন একটা বাধও সাধে বুকে...
"এ কি সংস্কার? বুকের ভেতর কিছু কিছু ধ্যানধারনা এমনভাবে গেড়ে বসে, সহজে তা যেন সরতে চায় না। চোখের সামনে দেখা অনেক ক্রূর সত্যও যেন তাকে হঠাতে পারে না সহসা।"

আবার স্ত্রী জয়ার কাছে তুলে ধরা কিছু ভাবনা...
"উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, সেখানে পৌঁছোনোর পথটা কখনও নোংরা হতে পারে না। আর যদি নোংরা পথ ধরেই এগোতে হয়, তা হলে উদ্দেশ্যটা পুরোপুরি মহৎ থাকতে পারে না।"

বোঝা যায় প্রভাসের নেয়া শেষের সিন্ধান্ত তার নিবার্ক প্রতিবাদ..... এমন ভাবনাগুলো তারই আভাস ছিল।

এ কাহিনীতে প্রতিটি চরিত্রই তার নিজ নিজ ভূমিকাতে স্বকীয়। অাঁখি, জয়া, অয়নও। বিপরীতধর্মী মতবাদগুলো নিমিষেই বদলে দেয় কাছের মানুষের রুপ। আবার আত্মিক টান মনে করে দেয় এদের ঘিরেই তো আবর্তন জীবনের। খুব বেশি সম্পর্কের টানপোড়ন কোথাও দেখা যায়না বরং অ্যাডযাস্টমেন্টটা বড্ড পরিচিত। আমরা তো তাই করি। নিজেদের জীবনে! কম্প্রোমাইজ, অ্যাডযাস্টমেন্ট!
কাহিনীর শেষটা এক আশা জাগানো, এক শক্তির আভাস দেয়....প্রভাস যখন শুনে শ্যামলীর ফিসফাস...বাতাসের ধ্বনিতে...
"না কাকাবাবু,। হারছে তো ওরা। ভয় পাচ্ছে বলেই না ভয় দেখাতে এত মরিয়া।"

"অনেক্ষণকর পর বুক ভরে বাতাস টানল প্রভাস। তার ক্ষীণ স্বরটুকু নয় ছড়িয়ে থাক রুদ্রপুরের মাটিতে। ধূলিকণার মতো।......"


***সুচিত্রা ভট্টাচার্য (১০ জানুয়ারী, ১৯৫০- মে ১২ ২০১৫ ইং) বিহারের ভাগলপুরে জন্ম, মৃত্যু নিজের বাসস্থান কলকাতার ঢাকুরিয়ায়। এককালে ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবি, পরবর্তীতে ডেডিকেটেড লেখিকা।

বৃহস্পতিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০১৫

A Reflection on Love...by-Yasmin Mogahed

এই সবকিছুই "ভালোবাসা"। প্রতিটি খন্ডই। পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তর। এ সেই "ভালোবাসা", যা দিয়ে রচনা হয় কবিতা। শব্দ দিয়ে গড়া উপন্যাসের ভালোবাসা। গানের মধ্যকার ভালোবাসা। কোন সিনেমার খাপে খোঁজা এই সেই "ভালোবাসা"।
সন্তানের প্রতি মায়ের সেই ভালোবাসা, ভালোবাসা পিতার জন্যে সেই মেয়েটির। এ সেই "ভালোবাসা" যা শেখায় স্বাধীন হওয়া আবার যা শেখায় নিজের অস্তিত্বকে ভুলে যেতে। সেই "ভালোবাসা" যেখানে একবার বিজয়ের স্বাদ আবার কখনো হেরে যাওয়া। "ভালোবাসা"... যা তুমি খুঁজে বেড়াও এদিক সেদিক।
"ভালোবাসা" যার জন্যে তুমি বাঁচতে শেখো আবার জানো কিভাবে আগলে নেয়া যায় মৃত্যুকে। "ভালোবাসা" যা রক্তাক্ত করে পুরুষকে। এ সেই "ভালোবাসা" যা তরবারিকে বাধ্য করে হরণ করতে। ভালোবাসা সেই রুপকথার কিংবা বিষাদময়, কোন ট্রাজিডির।
এ সবকিছুই "প্রতিফলন" শুধুমাত্র।
একই প্রতিধ্বনি, একই উ্ৎসের, একই "ভালোবাসা" যা জানো তুমি, যা জানি আমি। কারণ একে আমরা ঠিক জানার অনেক আগে থেকেই জানি। ভালোবাসতে জানবার বহু আগেই যে আমরা পেয়েছি "ভালোবাসা"! তুমি দেবার বহু আগেই পেয়েছো কিংবা জেনেছো কি আছে তোমার বিলিয়ে দেবার। এটা হচ্ছে "ভালোবাসা"... যাকে জানবার জন্যেই সৃষ্টি, তোমার হৃদয়। এ সেই "ভালোবাসা" যা বাকি সব ভালোবাসাকে করে সৃষ্টি, রাখে সযতনে আগলে।
এ সেই "ভালোবাসা" যার অস্তিত্ব বহু আগে থেকেই....থেকে যাবে অনন্তকাল বাকি সব চলে গেলেও, হারিয়ে গেলেও।
এ সেই "ভালোবাসা" যার অস্তিত্ব বহু আগে থেকেই...থেকে যাবে এর "প্রতিধ্বনি" অনন্তকাল। বাকি সব হারিয়ে গেলেও।



মূল: Reclaim Your Heart- By Yasmin Mogahed

(অনুবাদ করবার ব্যর্থ চেষ্টা। কেননা কোন অনুবাদই পারফেক্ট হতে পারেনা। লেখকের সাথে আরেক লেখকের শব্দ কখনোও এক হয়না। কিন্তু অনুভূতিগুলো তো এক হতে পারে!!! তারই প্রয়াস। দোষ কি তা তে!!! )

শুক্রবার, ১০ এপ্রিল, ২০১৫

সূর্য-দীঘল বাড়ী...A Cursed House!



আবার তারা গ্রামে ফিরে আসে। পেছনে রেখে আসে স্বামী-স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, মা-বাপ, ভাই-বোন। ভাতের লড়াইয়ে তারা হেরে গেল।

এই হচ্ছে শুরু......"সূর্য-দীঘল বাড়ী" এর।

আবু ইসহাকের এ এক স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি। বাংলা সাহিত্যের সার্থক উপন্যাস হিসাবে সমাদৃত। অুনদিত হয়ে বইটি বিভিন্ন বিদেশী ভাষাতেও প্রকাশিত হয়েছে। আবু বাশার মোহাম্মদ ইসহাক (আবু ইসহাক, ১৯২৬-২০০৩) এর জন্ম শরীয়তপুর জেলায়। সাহিত্যের সংখ্যা হয়ত বেশী নয় তবে যাই সৃষ্টি করেছেন তা এক একটি জেমস্ বললে ভুল হবে না।
আফসোস হচ্ছে কেমন করে যেন এই সাহিত্যটা পড়া হয়নি আগে। বঞ্চিত মনে হচ্ছিল নিজেকে। যাগ্ গে এ নিয়ে তো রিভিউ দেবার ক্ষমতা আমার মোটেও নেই । শুধুমাত্র নিজের অনুভুতিগুলোকে নিয়েই নাড়াচাড়া। সাধারণের সাহিত্যানুশীলন...এই আর কি।


"এক মুঠো ভাতের জন্যে বড়লোকের বন্ধ দরজার ওপর মাথা ঠুকে ঠুকে পড়ে নেতিয়ে। রাস্তার কুকুরের সাথে খাবার কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ক্ষত-বিক্ষত হয়। দৌলতদারের দৌলতখানার জাঁকজমক, সৌখিন পথচারীর পোশাকের চমক ও তার চলার ঠমক দেখতে দেখতে কেউ চোখ বোজে। ঐশ্বর্যারোহীর গাড়ীর চাকায় নিষ্পিষ্ট হয়ে প্রাণ হারায় কেউ বা।..............................তাদের শিরদাঁড়া বেঁকে গেছে। পেট গিয়ে মিশেছে পিঠের সাথে। ধনুকের মত বাঁকা দেহ- শুষ্ক ও বিবর্ণ।"

পঞ্চাশের মন্বন্তর এমনই ভাবে ফুটে উঠে। সহজ অথচ কত বৃত্তান্ত।
কাহিনী জয়গুনের...তার মেয়ে মায়মুন, ছেলে হাসুর। আর শফির মায়ের। আরো কাসুর, করিম বকশ, গদু প্রধান এর। আর 'সূর্য-দীঘল বাড়ী' !! এ হচ্ছে এর নিজের ইতিহাসেই এক কলংক, অভিশাপ। পূর্ব-পশ্চিম প্রসারী বাড়ী তাই সূর্য-দীঘল বাড়ী।


দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কুসংস্কারগুলো আপনাতে্ই কখন যেন মাথা থেকে পায়ের নিচে চলে আসে। ক্ষুধার কষ্ট বড় করুন। লেখক বলেছেন..

"রমজান মাসের রোজার চেয়েও যে ভয়ঙ্কর এ রোজা। রমজানের একমাস দিনের বেলা শুধু উপোস। কিন্তু তার বারোমেসে রোজার যে অন্ত নেই।"


অসহায় অবস্থায় অন্যের দারস্থ না হয়ে খেটে খাইতে গেলেও..সংগ্রাম করতে গেলেও অন্ধ সমাজের চোখ রাঙ্গানো এড়ানো বড় কঠিন। অন্ধ সমাজের সব কিছুর ব্যাখ্যা, সংগাও অন্ধ। সেখানকার ডিকশেনারিতে "মানবতা" শব্দটির নেই কোন অস্তিত্ব।
অথচ অনুভূতিগুলো কতটা গভীর। কিভাবে? মানুষ সত্যিই বিচিত্র। জয়গুনকে "তোবা" করতে হবে। না হয় মেয়ের বিয়ে আর দেয়া হবেনা। শুধু সে সময়টার জন্যে "তোবা" অথচ নাহ্...জয়গুনের বিবেক তাকে শিখিয়েছে "তোবা" একবার করলে তা সে ভাঙতে পারবেনা্। এই মানসিকতাকে কোন আঙ্গিকে বিচার করা যায়? আর সেই "তোবা"ই ভেঙে ঘরের বাইড়ে যেতে হয় যখন আরেক নারী তাকে সেই একই ধর্মের বাণী শোনায়..

"না খাইয়া জানেরে কষ্ট দিলে খোদা ব্যাজার অয়। মরলে পরে খোদা জিগাইব, তোর আত-পাও দিছিলাম কিয়ের লেইগ্যা? আত দিছিলাম খাটবার লেইগ্যা, পাও দিছিলাম বিদ্যাশে গিয়া ট্যাকা রুজি করনের লেইগ্যা। .....

"আত আছিল, পাও আছিল
আছিল গায়ের জোর।
আবাগী মরল ওরে
বন্দ কইরা দোর।"



আমার একটা প্রিয় কবিতা রবিঠাকুরের লেখা। যেখানে তিনি শরৎবাবুকে অনুরোধ করেছিলেন একটা সাধারণ মেয়ের গল্প লেখার জন্যে। জয়গুন কি সেই সাধারণ মেয়ে নাকি সংগ্রামী কোন নারী? গোর্কি এর মায়ের ছোঁয়া এতে? যে জানে কিভাবে সংগ্রাম করতে হয়!! জয়গুন কে রোল মডেল বানাতে কোনও অসুবিধা নেই।

"মেয়ে বলে মায়মুনকে এতদিন সে অনাদর করেই আসছে। কিন্তু অার না। হাসু কোলের আর মায়মুন পিঠের- তা তো নয়! দু'জনকেই সে পেটে ধরেছে।...."মায়মুনের জন্যে আর কোন দিন জয়গুন এমন করে ভাবেনি। আজ হাসু ও মায়মুন তার চোখে সমান হয়ে গেছে।"


কাসু যখন অসুস্থ জয়গুন ছুটে আসে তার পূর্বের স্বামীর ঘরে ফেলে আসা ছোট এই ছেলেটির টানে।....

"তোমরা ডাকতর দেহাইছিলা?
- ডাকতর কি করব? কত ফকির হট্ খাইয়া গেল!
অন্ধকারের মধ্যে জয়গুন আলো খুঁজে বেড়ায়। নিরাশার মধ্যেও আশা চেপে ধরে বুকে। ঝড়-ঝঞঝার মধ্যেও সে হাল ছেড়ে দেয় না।"



লেখক এক জায়গায় খুব চমৎকার কথা বলেছেন। বাস্তবতার আঙিনায় এ অনেক সত্যকথন।

"নিয়মের দুনিয়ায় অনেক অনিয়ম আছে। 'যেমন কর্ম তেমন ফল' তাই সব সময়ে পাওয়া যায় না। মাথার ঘাম পায়ে-ফেলা সারাদিনের কর্মফল বড় সামান্য। পরোপকার প্রায়ই বিফলে যায়। সে কর্মে যদিও ফল ফলে, তা তিতো, বিষাক্ত। এটা অনিয়ম বৈকি।"


সম্পর্কের টান-পোড়ন ছিল জয়গুন আর করিম বকশ এর। কাসুর জন্যে জয়গুনের হাহাকার আর কাসুর মায়ের কাছে যাবার আকুতি। আছে হাসুর অবিরত খাটুনি, মায়মুনের নিষ্পাপ শৈশব, রুগ্ন সমাজের পৈশাচিকতা আরও কত কি! শুধু বলব, আমার মতো যারা এতদিন বঞ্চিত ছিলেন... বইটাকে এখনই হাতে নিয়ে নিন।


লেখক শেষ করেছেন "সূর্য-দীঘল বাড়ী" এর ভুত ক্ষেপানো মধ্য দিয়ে। আর জয়গুনদের খোদার বিশাল দুনিয়ায় মাথা গুঁজবার একটু ঠাঁইয়ের খোঁজে।

"চলতে চলতে আবার জয়গুন পেছনে ফিরে তাকায়। সূর্য-দীঘল বাড়ী! মানুষ বাস করতে পারে না এ বাড়িতে। দু'খানা ঝুপড়ি। রোদ বৃষ্টি ও অন্ধকারে মাথা গুঁজবার নীড়। দিনের শেষে কাজের শেষে মানুষ পশু-পক্ষী এই নীড়ে ফিরবার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে। ঐ উঁচু তালগাছ অনেক কালের অনেক ঘটনার নীরব স্বাক্ষী এটা।
তারা এগিয়ে চলে।
বহুদূর হেঁটে শ্রান্ত পা-গুলোকে বিশ্রাম দেয়ার জন্যে তারা গাছতলায় বসে। উঁচু তালগাছটা এত দূর থেকেও যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে।
আবার তারা এগিয়ে চলে.........।"




বাংলা একাডেমী পুরস্কার : ১৯৬২-৬৩
সুন্দরবন সাহিত্য পদক : ১৯৮১
একুশে পদক : ১৯৯৭
স্বাধীনতা পদক মরনোত্তর : ২০০৪






এ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র "সূর্য-দীঘল বাড়ী" ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও বেশ কয়েকটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে।
* ১৯৮০ সালে পশ্চিম জার্মানীতে অনুষ্ঠিত ২৯তম ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে "ডুকার্ট" (স্বর্ণপদক)।
* ম্যানহেইম চলচ্চিত্র উৎসবে 'মানবিক আবেদনের' জন্যে আন্তর্জাতিক ইভানজ্যালিক্যাল (প্রোটেস্ট্যান্ট) সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক ক্যাথলিক সংস্থার দুটি বিশেষ পুরস্কার।
* পুর্তগালে অনুষ্ঠিত ১৯৮০ সালের 'নবম ফিগুয়েরা দ্য ফজ' আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উ্ৎসবে ফেডারেশন অব ফিল্ম সোসাইটিজ-এর 'প্রিকস ডন কুইকজোট' পুরস্কার।
* ২২তম ১৯৮০ কার্লোভিভেরী (চেকোশ্লোভাকিয়া) চলচ্চিত্র উৎসবে ডিপ্লোমা লাভ।
* নেদারল্যান্ডের ইন্টার চার্চ ফিল্ম সেন্টার এর বিশেষ পুরস্কার 'ইন্টার ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড' ১৯৮০।
* বাংলাদেশের ১৯৭৮ সালের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে 'জাতীয় পুরস্কার' ও বিভিন্ন বিভাগে আরো 'আটটি' পুরস্কার।
* ১৯৭৯ সালের শ্রেষ্ঠ ছবি হিসাবে 'বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির' পুরস্কার ও বিভিন্ন আরো 'পাঁচটি' পুরস্কার।

সাহর- শাহরিয়ার খান শিহাব

#পাঠপ্রতিক্রিয়া: "বড় হুজুর বলেন, 'শয়তান কাউকে নিজের দলে আসতে বাধ্য করে না। করতে পারেও না, সেই ক্ষমতাও তার নাই। সে শুধু আহবান করে, ফ...